শিশুদের শিক্ষার জন্য বই-পুস্তক ও শিক্ষাগুরুর পাশাপাশি কোন পরিবেশে তারা পড়াশোনা করছে সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার সার্বজনীন প্ল্যাটফর্মটি হওয়া উচিত মুক্তমনা ও আনন্দপূর্ণ। জীবনের এই প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ পরবর্তীতে যে কোন উচ্চ শিক্ষার জন্য মেধা ও মননের ভিতটা মজবুত করে। ঠিক তেমনি এক অভাবনীয় আদর্শের নাম চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সাধ্যের মত যতটুকু সম্ভব ততটুকু দিয়ে যে একটা স্কুলকেও দৃষ্টিনন্দন করে তোলা যায়, তা এই বিদ্যালয়টিকে না দেখলে বিঃশ্বাস হয়না। চলুন, এই অসাধারণ স্থাপনশৈলীতে সমৃদ্ধ এই স্কুলটি নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের নয়নাভিরাম বিদ্যাপীঠ
ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের শান্ত গ্রাম চরভিটায় গড়ে ওঠা ব্যতিক্রমধর্মী এক বিদ্যাপীঠ ‘চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। শহরের পিচঢালা পথ ছাড়িয়ে চরভিটার আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোলে ভারতের সীমান্তের প্রায় দুই কিলোমিটার আগেই দেখা মেলে কারুকার্যমন্ডিত প্রাচীর ঘেরা এই বিদ্যাপীঠের। রঙ-বেরঙের প্রচ্ছদের ভবন সমৃদ্ধ খোলামেলা জায়গাটি সূর্যের আলোয় যেমন ঝলমলিয়ে ওঠে, রাতের ল্যাম্পশেডের আলোয় ঠিক তেমনি পরিণত হয় এক নিভৃত নিসর্গে।
এর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে প্রায়ই এখানে ভীড় করেন অনেক দর্শনার্থী।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া বিষয়ে সিদ্ধান্ত রবিবার
ছাত্র-ছাত্রীদের বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র
এখানে শিশুদের বিনোদনের জন্য বানানো হয়েছে শিশুপার্ক ও ছোট্ট চিড়িয়াখানা। খেলার মাঠ, দোলনা, গরুর গাড়ি আর পুকুরের নৌকা প্রতিদিনি মুখর হয়ে থাকে শিশুদের কোলাহলে। দেয়ালগুলো পরিপূর্ণ স্বাধীনতার মহান পুরুষদের প্রতিকৃতি, কবি সাহিত্যিকদের উক্তি এবং বিভিন্ন প্রাণীর ছবিতে। ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্তাকার আকৃতি দেয়া হয়েছে ফুলের গাছগুলোতে।
মিনি চিড়িয়াখানায় রঙবেরঙের ফুল গাছের মাঝে ঊঁকি দেয় হাতি, ঘোড়া, হরিণ, জিরাফ, বক, ও ময়ূরের নিষ্প্রাণ চাহনীগুলো। আরও দেখা যায় খরগোশ, টার্কি, টিয়া, ঘুঘু, তিতির, কবুতর, রাজহাঁস, পাতিহাঁস ও চিনাহাঁস।
খড়-বাঁশের ঘর থেকে পূর্ণাঙ্গ স্কুলে পরিণত হওয়ার গল্প
২০০০ সালে বকুয়ার বহরমপুর বাজারে ছিলো এরফান আলীর চা-নাশতার দোকান। পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিনে দু-তিনবার করে তিনি চা দিয়ে আসতেন। উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করা এরফানের স্বপ্ন ছিলো শিক্ষক হওয়ার। ২০০১ সালে ছেলের স্বপ্নের কথা শুনে নিজের জমির ৩৩ শতাংশ জায়গা পরিষ্কার করে খড়-বাঁশের তিনটি স্কুলঘর উঠান বাবা নুরুল ইসলাম। গোড়াপত্তন হলেও সেটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া ছিলো বেশ দুষ্কর।
২০০৮ সালে স্নাতক পাসের পর ২০১১ সালে তার দায়িত্ব নেন এরফান আলী। সে বছরই পাঠদানের অনুমতি পেয়ে যায় বিদ্যালয়টি।
আরও পড়ুন: ঢাবি কর্তৃপক্ষকে একাডেমিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর
প্রথমে বিনা বেতনে পড়ানোর জন্য কোন শিক্ষক না পেয়ে এরফান আলী তার স্ত্রী ও তিন বোনকে নিয়ে নিজেই বাচ্চাদের পড়াতে লেগে যান। গ্রামের এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে তারা ছাত্র-ছাত্রী যোগাড় করতেন।
২০১৩ সাল নাগাদ স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৫০-এ দাড়ালো, কিন্তু তাদের মধ্যে নিয়মিত ছিলো ৫০ থেকে ৬০ জন। তাই ছাত্র-ছাত্রীরা যেন ঝড়ে না যায়, সেজন্যে ২০১৪ সালে শুরু করা হয় দুপুরে খাওয়ার কার্যক্রম।
স্কুল ভবনের পাশের পুকুরে মাছ ও হাঁস চাষ, ভবনের চারপাশে পেঁপে চাষ করে সপ্তাহের দুই দিন দুপুরের খাবার চালিয়ে যান এরফান আলী। এই কৃষি কাজে স্কুলের শিক্ষার্থীরাও সাহায্য করেছে। এরপরেও দুপুরের খাবার চালানোটা যখন প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিলো, তখনি মুষ্টির চাল দিয়ে উদ্যোগটাকে চালু রাখলেন বাচ্চাদের অভিভাবকরা।
সাধারণত ডে মিলের জন্য প্রতি মাসে খরচ পড়তো ৩০ থেকে ৩৩ হাজার টাকা। তাই একটা নির্ভরযোগ্য স্থায়ী আয়ের খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। এমতাবস্থায় বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম নিজের এক বিঘা জমি ও ছয় বিঘার একটি পুকুর সাময়িকভাবে বিদ্যালয়ের ব্যবহারের জন্য দান করেন। এছাড়া খাবার তৈরির জন্য প্রতি মাসের প্রয়োজনীয় লবণ ও তেলও সরবরাহ করেন তিনি।
এছাড়াও সে সময়ে বকুয়ার চেয়ারম্যান আবু তাহের ও স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সহ-সভাপতি মো. কলিমউদ্দিন সহ গ্রামের আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে এলেন মিড ডে মিল-এর সাহায্যার্থে।
আরও পড়ুন: ফ্লাই ডাইনিং: কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বাংলাদেশের প্রথম ঝুলন্ত রেস্টুরেন্ট
ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ প্রচেষ্টায় চলতে থাকলো পুকুরে হাঁস আর দুই বিঘা জমিতে সবজি চাষ। এ থেকে উপার্জিত টাকার পুরোটাই জমা হত মিড ডে মিলের তহবিলে।
ফলশ্রুতিতে ক্লাসে নিয়মিত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৫ শতাংশে। ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর স্কুলটি সে সময়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান লাভ করে।
চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সার্বিক অবকাঠামো
স্কুল কাঠামোর অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখে পেরিয়ে গেছে দশটি বছর। একদম শুরুর দিকে এলাকাবাসীর সহায়তায় বিদ্যালয়ের চারপাশ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিলো প্রাচীর। পরবর্তীতে স্কুলের নিজ অর্থায়নে দ্বিতল ভবনের ছাদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কম্পিউটার ল্যাব। স্কুল ভবনের উত্তরে গড়ে তোলা হয়েছে হাঁস-মুরগির খামার ও বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব লাইব্রেরি। পশ্চিম পাশে বানানো হয়েছে সিসি ক্যামেরাযুক্ত কন্ট্রোল রুম, মসজিদ, মাছ চাষের পুকুর ও সততা ক্যান্টিন। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য আছে পৃথক পৃথক স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট।
২০১৬ সালে স্কুলটির জাতীয়করণের ঘোষণার পর সরকারের পক্ষ থেকে এককালীন অনুদান পাওয়ায় বিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নের কাজ আরও গতিশীল হয়।
২০২০ সালে স্কুলটিতে চার তলা ফাউন্ডেশনের উপর চার কক্ষের একটি নতুন ভবন তৈরী করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৪২০ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা সাতজন। স্কুলের একদম শুরু থেকে সবার প্রিয় শিক্ষক এরফান আলী স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের দশটি প্রাচীন মসজিদ: দেশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন