জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) সেশনজট কাটানোর কথা বলে একেক পর এক পরীক্ষাবিধি লঙ্ঘন যেন শিক্ষার্থীদের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক সঙ্গে একাধিক শিক্ষাবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা এবং এক শিক্ষাবর্ষের ফলপ্রকাশ না করেই পরের শিক্ষাবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার রেওয়াজ যেন চালু হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষের বদলে ব্যক্তিগত কাজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে সময় বেশি দেওয়ায় নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া ও ফলপ্রকাশ না করার জন্য এই অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস সূত্র অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি; নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা; আইন ও বিচার; বাংলা এবং ফার্মেসিসহ পাঁচটি বিভাগে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনিস্টিউটে ২০১৭-২০১৮ (৪৭ ব্যাচ) শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের তৃতীয় বর্ষের ফল প্রকাশ না করেই ২৩ জুলাই থেকে স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষা চলমান।
তৃতীয় বর্ষের ফল প্রকাশ না করে চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইনিস্টিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, ‘আমার ইনিস্টিউটে শিক্ষক সংকট, তাই ফলাফল প্রকাশ করতে দেরি হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: জাবিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু, প্রতি আসনের বিপরীতে লড়ছেন ১৩৫ জন পরীক্ষার্থী
এদিকে, আইন ও বিচার বিভাগের ২০১৬-২০১৭ (৪৬ ব্যাচ) এবং ২০১৭-২০১৮ (৪৭ ব্যাচ) শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ২৫ জুলাই থেকে একই রুটিনে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা চলমান। ইতোপূর্বে তাদের স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষা একই সঙ্গে সম্পন্ন হয়।
স্নাতক পরীক্ষায় ৪৬ ব্যাচে ৯ জন ও ৪৭ ব্যাচে ৮ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। প্রচলিত নিয়মে মান উন্নয়ন পরীক্ষা না দিয়ে বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে তারা স্নাতক শেষ করে, কেন না একই সঙ্গে দু’টি ব্যাচ স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত।
উল্লেখ্য, বিশেষ পরীক্ষা জন্য গুনতে হয় ১৪ হাজার টাকা, যা অনেক শিক্ষার্থীর জন্য বহন করা কষ্টসাধ্য।
এ বিষয়ে বিভাগীয় সভাপতি এবং আইন ও বিচার অনুষদের ডিন সহযোগী অধ্যাপক তাপস কুমার দাস বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা দুটো শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা একসঙ্গে নিচ্ছি। আমাদের বিভাগে ক্লাসরুম ও শিক্ষক সংকট থাকা সত্ত্বেও আমরা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য দ্রুত শিক্ষাজীবন শেষ করার লক্ষে পরীক্ষা নিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদিও দুটো ব্যচের পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বিধিতে বলা নেই তবে উপ উপাচার্য (শিক্ষা) থেকে আমরা নিয়ম মেনে অনুমতি নিয়েছি।’
বিশেষ পরীক্ষার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার শিক্ষার্থীর কোনো ফি ছাড়াই বিশেষ পরীক্ষা দিয়েছে।’
কিন্তু আইন বিভাগের বিশেষ পরীক্ষার দেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা নিজ খরচে পরীক্ষা দিয়েছে।
আরও পড়ুন: গণরুম বিলুপ্তির দাবিতে জাবি শিক্ষার্থীর অনশন
উল্লেখ্য, আইন ও বিচার বিভাগ এবং জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে সমান সংখ্যক শিক্ষক কর্মরত। তবে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ সঠিক সময়ে শিক্ষার্থীদের ফল প্রকাশ করেছে কোনো রকম আইনের ব্যত্যয় ছাড়াই।
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে ফল প্রকাশের দীর্ঘ্যসূত্রিতা দেখা দেয়, যার ফলে ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার পূর্বেই ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর পরীক্ষার সম্পন্ন হয়।
এই বিষয়ে বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক ড. আনিশা নূরী কাঁকন বলেন, আমার বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় শ্রেণিতে থিসিস থাকায় ফল প্রকাশ করতে দেরি হয়েছে। কেন না থিসিস মূল্যায়ন একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাবিধি ২০০৩ এর ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে, প্রতি ৫ খাতার জন্য ১ দিন হিসেবে মোট সময় (দিন) হিসাব করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে খাতা দেওয়া হবে। ২৬(৩) ধারায় বলা হয়েছে লিখিত পরীক্ষা শেষ হবার ৭৫ দিনের মধ্যে অবশ্যই ফল প্রকাশ করতে হবে।
পরীক্ষাবিধির ৩০ ধারায় আছে, থিওরি (ব্যবহারিক) পরীক্ষা শেষ হবার ৩ মাসের মধ্যে অবশ্যই থিসিস জমা দিতে হবে।
এদিকে, ৪৫ ব্যাচের ১২ জন শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তরে অংশ গ্রহণ করেছে। তবে তাদের থিওরি পরীক্ষা ২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শেষ হলেও ফল প্রকাশ হয়েছে ১০ মাস পরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে।
একই ধরনের দীর্ঘসূত্রিতা দেখা গেছে বাংলা বিভাগে। যেখানে ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষে ফলপ্রকাশ করার আগেই ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষায় শুরু হয়।
অন্যদিকে, ফার্মেসি বিভাগ ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশ না করে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষার শেষ হয় এবং ফল প্রকাশ করতে প্রায় দুই বছর সময় ব্যয় করা হয়।
আরও পড়ুন: সাংবাদিক শামসের মুক্তির দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ জাবির প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের ফলাফলের কি অবস্থা তা জানার জন্য এবং সেশনজট কাটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনদের সঙ্গে আলোচনা করেছি।’
তিনি আরও বলেন, আইন অনুষদের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণ করে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছি। তবে একসঙ্গে দুই শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। আমাদের শিক্ষকদের ৫টি খাতা মূল্যায়নের জন্য ১দিন করে সময় দেওয়া হয়, যা ৭৫ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট।
বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ব্যপারে তিনি বলেন, ‘নতুন শুরু হওয়া একটি বিভাগে এই ধরনের বিধি লঙ্ঘন করে পরীক্ষা নেওয়া কাম্য নয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে সেশনজট মুক্ত করতে ছাত্র-শিক্ষক সকল অংশীজনের থেকে সহযোগিতা চাই।’