গত ১০ মাসে একদিকে কমেছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, অন্যদিকে তলানিতে কর্মসংস্থান; এ অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে বলে শঙ্কা অর্থনীতিবিদ এবং খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে, চলতি অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে তিন দশমিক তিন শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন—এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কমবে উল্লেখযোগ্যহারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৭০ শতাংশের বেশি।
এপ্রিলে দেওয়া বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে নতুন করে ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্রের কবলে পড়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে বিনিয়োগের এ বেহাল দশা এবং অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যার সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের ওপরে।
দিনকে-দিন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশের জনগণের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর টাকা পাচারকারী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর অনেকেই পালিয়ে গেছেন। সেখানে বড় সুযোগ ছিল পুরো কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর, কিন্তু তা হয়নি। আগে যে নিয়মে অর্থনীতি চলে এসেছে একই ধারা বজায় রাখায় বর্তমানেও কোনো সুফল আসেনি।’
আরও পড়ুন: পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে: গভর্নর
শিল্প পুলিশের তথ্যনুযায়ী, প্রধান তিন শিল্প এলাকা গাজীপুর, নারায়ণঞ্জ-নরসিংদী এবং সাভার-ধামরাই এলাকায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন ৬০ হাজারের বেশি কর্মী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ কারখানা বন্ধের প্রধান কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা এসব কারখানায় বিনিয়োগ করেছেন, তারা অনেকে কারাগারে, অনেকে গেছেন পালিয়ে, কেউ কেউ দিয়েছেন গা-ঢাকা। নতুন করে কারখানা চালু করতে যে অর্থের প্রয়োজন; সেটি না থাকা এবং ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতে হয়েছে উৎপাদন।
এ প্রসঙ্গে আনু মুহম্মদ বলেন, ‘শতাধিক কলকারখানা বন্ধ হওয়ায় নতুন করে কয়েক লাখ লোক বেকার হয়েছেন। যারা কারখানা বন্ধ করে পালিয়ে গেছেন, তাদের অনেকেই বিগত সরকারের আমলে অবৈধ সুবিধাভোগী মানুষ। শাস্তি সুবিধাভোগীরা পাবে কিন্তু যারা এসব কারখানায় কাজ করেন, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না রাখা বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ না। এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য।’
জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর বদলে আগামী অর্থবছরের বাজেটে আমদানি নির্ভরতা বাড়াবে। বিশেষ করে দেশীয় শিল্পকে উপেক্ষা করে বিদেশি আমদানি ওপরে নির্ভরশীলতা- সংকট আরও ঘনীভূত করবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
এদিকে যে-সব কারখানা চালু আছে, সেখানে দিনকে দিন প্রকট হচ্ছে অর্থ প্রবাহ, সংকট জ্বালানির। চাহিদার সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতি এবং ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগানের অভাব অনিশ্চিত করে তুলেছে শিল্পখাতকে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) পরিচালক আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে কারখানা চালানো দিনকে দিন কঠিন হয়ে উঠেছে।’
আরও পড়ুন: ব্যাংকে নতুন নোট নেই, চড়া দামে মিলছে খোলাবাজারে
‘জ্বালানি সংকটে ভুগছে বেশিরভাগ কারখানা। কারখানায় উৎপাদন কম হলে এর প্রভাব সরাসরি অর্থনীতিতে পড়বে,’ যোগ করেন তিনি।
এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘অন্যদিকে ২০১২-২০২২ এই দশ বছরে বেসরকারি খাতে আর্থিক প্রবাহ ছিল শক্তিশালী। দিনকে দিন এই ক্রেডিট ফ্লো কমে আসায় বেসরকারি খাত রীতিমতো ধুকছে। মালিকদের হাতে অর্থ নেই, কারখানায় উৎপাদন নেই; ফলাফল শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারা এবং অর্থনীতিতে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া।’
আশরাফ বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা এলেও বাকি খাতগুলো এখনো নড়বড়ে। দেশের অনেক ব্যাংক এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে, তারা ব্যবসায়ীদের অর্থের জোগান দিতে পারছে না। অন্যদিকে প্রায় ১৬ শতাংশ হারে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালানো রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘শিল্পকারখানায় গ্যাসের অভাবে উৎপাদন নেমেছে প্রায় অর্ধেকে। এ অবস্থায় জ্বালানি বিভাগ নতুন করে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন করে দেশে কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়া, বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারা এবং দিন দিন গ্যাসের রিজার্ভ কমে যাওয়ায় শুধু আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা পরিস্থিতি আরও সংকটময় করে তুলছে।’
বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের ২৬ ব্লক থেকে বাংলাদেশ কেন জ্বালানি সুবিধা নিতে পারছে না এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডাকা হলেও কোনো কোম্পানি আগ্রহ দেখায়নি। নতুন সরকার দরপত্রের সময়সীমা বাড়িয়েও সাড়া পায়নি। এতে করে আপাতত বঙ্গোপসাগর থেকে জ্বালানি সুবিধা পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।’
কেন আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের জ্বালানি এ অপার সম্ভাবনার খাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না; এমন প্রশ্নের জবাবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার এ সময়ে কোনো কোম্পানিই নীতিগত নিশ্চয়তা ছাড়া নতুন কোনো চুক্তিতে যেতে চাইবে না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আসা।’
আরও পড়ুন: সরকার পুঁজিবাজার উন্নয়নে আন্তরিক: বিএসইসি চেয়ারম্যান
যতই সাংবিধানিক বা নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার হোক না কেন, গত ১০ মাসে ২১ লাখ মানুষ যারা কাজ হারিয়ে বেকার বসে আছেন, যাদের মধ্যে ১৮ লাখই নারী এদের ব্যাপারে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত জরুরি বলে মনে করেন তৌফিক।
সরকারের পদক্ষেপ প্রসঙ্গে সরকারের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে এসে বিনিয়োগ, ব্যাংক এবং জ্বালানির যে-সব সমস্যা দেখা যাচ্ছে, এর প্রত্যেকটি বিগত সরকারের আমলের দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফসল, যার ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে এখন।’
যারা বর্তমানে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন তারা ধীরে এগনোর নীতিতে আছেন। বিশেষ করে নির্বাচন পরবর্তী সরকারের নীতি কেমন হবে, তার ওপর আগামী দিনের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের অর্থনীতির অনেক ভুল নীতির মাশুল আগামী আরও কিছু সময়েও দিতে হবে বলে মনে করেন হেলাল উদ্দিন।