বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আইনের শাসন সমুন্নত রেখে মানুষের নাগরিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে যা যা করা প্রয়োজন আমরা তা করব।’
২০১৮ সালের ৩০ ডিসম্বের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস জয়ের পর শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেন। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি গঠিত এ সরকার দুই বছর পূর্ণ করে আজ তৃতীয় বছরে পা দিয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় একযোগে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচার করে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা কঠোর হস্তে জঙ্গিবাদের উত্থানকে প্রতিহত করেছি। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ পারস্পরিক সহনশীলতা বজায় রেখে বসবাস করে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন।’
আরও পড়ুন: বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের যে মহাসড়ক বেয়ে দুর্বার গতিতে ধাবিত হচ্ছে তা যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত হতে না পারে সে দিকে দেশবাসী সকলকে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উন্নয়নের পথে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেয়া হবে না
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু অসাধু মানুষ নানা কৌশলে জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক আর যত শক্তিশালীই হোক, তাদের ছাড় দেয়া হচ্ছে না এবং হবে না। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে।’
বাংলাদেশ গত ১২ বছরে হয়েছে আত্মমর্যাদাশীল দেশ
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১২ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
‘আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬৬ উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ,’ বলেন তিনি।
তিনি জানান, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের সমৃদ্ধশালী-মর্যাদাশীল দেশ। বাংলাদেশ ২০২১ সালের পূর্বেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণের সরকার হিসেবে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলেই আমি মনে করি। গত এক যুগে আমরা জনগণের জন্য কী করেছি তা মূল্যায়নের ভার আপনাদের।’
তিনি উল্লেখ করেন যে রূপকল্প ২০৪১-এর কৌশলগত দলিল হিসেবে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে। গত সপ্তাহে ২০২১-২০২৫ মেয়াদি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে। সেই সাথে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ শীর্ষক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: মানবাধিকার, আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন: পুলিশদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী জানান, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়ন শেষে দারিদ্র্যের হার ১৫.৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭.৪ শতাংশে নেমে আসবে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর ১০টি উদ্যোগ বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে যা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হবে, বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের মহামারি সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতি সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে।’
পদ্মা সেতুর ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করি আগামী বছর এই স্বপ্নের সেতু যানবাহন এবং রেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, অন্য বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কাজও পুরোদমে চলছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে রেললাইন বসানো হয়েছে। শিগগিরই জাপান থেকে ট্রেন ঢাকায় পৌঁছবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ হাজার২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজের ৮০ শতাংশ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলের নির্ধারিত সময়ের আগেই এই ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন: করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে না: প্রধানমন্ত্রী
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে এবং ইতোমধ্যে এই ট্যানেলের ৬২ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ২০০৫-০৬ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হবে। সব ঘর আলোকিত হবে।
খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ং সম্পূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ থেকে তৃতীয় স্থান উন্নীত হয়েছে। মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ং-সম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।
তার দল প্রথম গ্রামোন্নয়নকে নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষটি অন্তর্ভুক্ত করে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের অঙ্গীকার করি। সারা দেশে পল্লী এলাকায় ৬৩ হাজার ৬৫৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ৩ লাখ ৭৬ হাজার ব্রিজ-কালভার্ট, ১ হাজার ৬৮৫টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, ৯৩৬টি সাইক্লোন সেন্টার এবং ২৪৯টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন: জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করুন: প্রধানমন্ত্রী
এছাড়া ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৫৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। আরও ৬৬১ কিলোমিটার মহাসড়ক চার এবং তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে।
তিনি স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, রেলপথ, বিমান ও আইটিসহ বিভিন্ন খাতে তার সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম তুলে ধরেন।
কোভিড-১৯ এবং টিকা
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে আমাদের বিগত ২০২০ সাল অতিক্রম করতে হয়েছে। সেই সাথে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং উপর্যুপরি বন্যা আমাদের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।’
তবে সরকার দৃঢ়ভাবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার বাংলাদেশে এখনও কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এই মহামারিটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ১৮ মার্চ প্রথম একজনের মৃত্যুর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭ হাজার ৭১৮ জনে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া, মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখ ১৯ হাজার ৯০৫ জনে পৌঁছেছে।
আরও পড়ুন: বাড়ি ভাড়া ভাতা পেতে সরকারি বাসায় থাকতেই হবে: প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুতে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম যে দেশবাসীর সহায়তায় আমরা এই দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবিলা করব। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে দেশবাসী এ দুঃসময়ে আমার এবং আমার সরকারের পাশে ছিলেন। আপনারা আমাদের এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছেন। এ ধরনের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভবিষ্যতেও আপনাদের পাশে পাব- এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।’
তিনি বলেন, শিগগিরই কোভিড-১৯ টিকা আমদানির জন্য সরকার সকল প্রকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসার পরপরই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যসহ সম্মুখসারির যোদ্ধাদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে টিকা প্রদান করা হবে।
‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন’
প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, সরকার মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে শান্তিপূর্ণভাবে নিজ দেশে ফেরৎ পাঠানোর সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
আরও পড়ুন: জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে পাশে দাঁড়ান: সেনাবাহিনীকে প্রধানমন্ত্রী
কক্সবাজারে বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য ভাষানচরে ১ লাখ মানুষের বসবাস উপযোগী উন্নতমানের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে শুধু স্ব-ইচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাঠানো হচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন ভাইরাস পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগামী ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। করোনাভাইরাসের প্রকোপ না থাকলে আমরা সাড়ম্বরে এই অনুষ্ঠান উদযাপন করব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারি ছড়িয়ে পড়ার কারণে অনুষ্ঠানমালায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী বাংলাদেশ গড়ে তুলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান।