বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে বাগেরহাট, ঝালকাঠি, ভোলা, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
বাগেরহাটে গত তিন দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা।
সোমবার বিকালে ভৈরব, বলেশ্বর, পানগুছি ও পশুর নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দুই ফুট বেড়েছে এবং সুন্দরবনে পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট বেশি উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে।
এমতাবস্থায় বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ স্থানের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে।
সুন্দরবনের সব পুকুর উপচে উঠেছে এবং এ অবস্থা আরও কয়েক দিন চলতে থাকলে বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকার মাছের ঘেরগুলো যে কোনো সময় ভেসে যেতে পারে।
এদিকে সাগর উত্তাল থাকায় জেলেসহ বেশ কিছু মাছ ধরার ট্রলার সুন্দরবনের দুবলারচর, নারিকেলবাড়িয়া ও কটকায় আশ্রয় নিয়েছে।
মোংলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অমরেশ চন্দ্র ঢালী জানান, স্থল নিম্নচাপটি বর্তমানে ভারতের দক্ষিণ মধ্যপ্রদেশে ও এর পাশ্ববর্তী এলাকায় অবস্থান করছে। এটি স্থলভাগের ওপর দিয়ে আরও পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ দুর্বল হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। পূর্ণিমা ও স্থল নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সমূহের নিম্নাঞ্চল এক থেকে দুই ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
নিম্নচাপের প্রভাবে মেঘনা নদীর জোয়ারে ভোলার নিম্নাঞ্চল দুই থেকে তিন ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে করে ভোলার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলসহ বেড়িবাঁধের বাইরের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ছে।
এছাড়াও জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইলিশা ফেরিঘাটের গ্যাঙওয়ে ডুবে গিয়ে ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অতি জোয়ারে ভোলার রাজাপুর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের বাইরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ সকাল ও বিকাল পানিবন্দী হয়ে পড়ে।
এছাড়াও ভোলা দৌলতখানের মদনপুরা, তজুমদ্দিনের চরজহিরউদ্দিন, চরফ্যাশনের ঢালচর, চর কুকরিমুকরি, মনপুরার কলাতলির চরসহ প্রায় ১০ থেকে ১২টি চরের বাসিন্দারা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
জোয়ারেরর পানিতে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিনফুট প্লাবিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ: চার জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন ঢালচরের চেয়ারম্যান মো. আবদুস ছালাম জানান, তার চরে প্রায় ১২ হাজার লোকের বসবাস। বেড়িবাঁধ না থাকায় এ চরের মানুষ জোয়ারের পানিতে ভাসতে হয়। জোয়ারে তার ইউনিয়নে প্রায় তিন ফুট পর্যন্ত প্লাবিত হয়েছে। তবে ভাটার সময় পানি নেমে যাওয়ায় মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে আছে।
ভোলা আবাহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক মো. মাহবুবুর রহমান জানান, রবিবার দুপুর ১২টা থেকে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোলায় ৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান জানান, সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে বাধেঁর বাইরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
সাতক্ষীরার আশাশুনির খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাধঁ ভেঙে ২০০ বিঘা মাছের ঘের প্লাবিত হয়ে গেছে। সোমবার বেলা ১১ টার দিকে উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের গদাইপুরে নদীর ৬-৭ হাত বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এ প্লাবনের ঘটনা ঘটে। তবে স্থানীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাশ্রমে সেটি সংস্কার করা হয়েছে।
আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউপি চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ ডালিম জানান, তার ইউনিয়নের গদাইপুর এলাকার আব্দুল মান্নান মাস্টারের মাছের ঘের সংলগ্ন এলাকায় ৭/২ নং পোল্ডারে সোমবার খোলপেটুয়া নদীর ৬-৭ হাত জরাজীর্ণ বেড়িবাধঁ ভেঙে যায়। এতে প্রায় ২০০ বিঘা মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে যায়। পরে দুপুরের মধ্যে তিনি স্থানীয়দের নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে তা সংস্কার করতে সক্ষম হয়েছেন।
তবে পরবর্তী জোয়ারে কি হবে তা বলা যাচ্ছেনা বলে জানান তিনি।
শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, রবিবার থেকেই থেমে থেমে হালকা, মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারি বর্ষণের কারণে শতাধিক ঘের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এছাড়া গাবুরা, নাপিতখালি, জেলেখালি, তিন নম্বর পোল্ডারসহ বিভিন্ন এলাকায় উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে যেতে পারে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগের আওতায় মোট ৮০০ কিলোমিটার বেড়িবাধেঁর মধ্যে জরাজীর্ণ ৩৫ টি পয়েন্টে প্রায় ৬২ উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে, অনেক জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কার চলমান।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ২ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, বঙ্গপোসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
আগামী ২-১ দিন আবহাওয়ার এমন পরিস্থিতি থাকবে তারপর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেও জানান তিনি
তিনি বলেন, গত ২৪ ঘন্টায় ৫৯ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
আরও পড়ুন: জোয়ারের পানিতে বাগেরহাটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
ঝালকাঠির বিষখালী ও হলতা নদীর পানি ৩-৪ ফুট বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কাঠালিয়া উপজেলার অর্ধশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ২৭টি গ্রাম ও শতাধিক আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর প্লাবিত হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে কাঠালিয়া গ্রামের বিষখালী নদীর তীরবর্তী রাস্তা ও চিংড়াখালী খালের বাঁধ।
গ্রামীণ কাঁচা পাকা ১০টি রাস্তা ডেবে গর্ত হয়ে সংযোগ বিচিছন্ন রয়েছে এ সকল গ্রামের। ফলে হাজার হাজার মানুষের চরম দুর্ভোগ ও আতংকের মধ্যে দিন কাটছে।
রবিবার থেকে মুশলধারে বৃষ্টি, বৈরি আবহাওয়া, বিষখালী ও হলতা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ অর্ধশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে পানি ঢুকে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ২৭টি গ্রাম।
জোয়ারের পানিতে উপজেলার আউড়া, শৌলজালিয়া ও আওরাবুনিয়া আশ্রায়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘর পানিতে ভাসছে। ২/৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে এ সব ঘর।
উপজেলা পরিষদের সবগুলো অফিস ভবন, নির্বাহী অফিসারের বাস ভবন, কাঠালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ, কাঠালিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিকল্যাণ কেন্দ্র, ছৈলার চর পর্যটন কেন্দ্র, কাঠালিয়া লঞ্চ ঘাট, সিকদার পাড়া, পশ্চিম আউরা জেলে পাড়া, আমুয়া হাসপাতাল ও আমুয়া বন্দরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন স্থান ৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, দুই/এক দিনের ভিতর পানি না কমলে রোপা আমন ধান পঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, তাদের ৪০ শতাংশ মাছের ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে। ফলে এ সকল খামারিদে অর্ধকোটি টাকা ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
কাঠালিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মিজানুর রহমান জানান, কাঠালিয়া উপজেলাকে সরকারের পক্ষ থেকে কোস্টাল এরিয়া ঘোষণা করা এবং বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে এলাকার মানুষের দুর্ভোগের সমাধান সম্ভব নয়।
ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ড জানান, বিষখালী ও হলতা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ অঞ্চলের সব কয়টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলা সদরের নিচু এলাকা রবিবার জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ধসে প্লাবিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু চত্বর, কাঁচাবাজার এলাকাসহ কয়েকটি নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণে নবনির্মিত শহর রক্ষা বাঁধের সামনের অংশটি ধসে পড়ে।
স্থানীয়দের অভিযোগ,পাইকগাছা পৌর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পৌরসভাকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে অপরিকল্পিতভাবে শিবসা নদীর চরভারতী এলাকায় বাঁধটি নির্মাণ করা হয় যা চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয়।
মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বাঁধের ভেতরে শুরু হয়েছে মাছ চাষ।
চরভারতীর বিস্তীর্ণ এলাকার আশেপাশে বাস্তবায়িত বনায়ন প্রকল্পের বেশ কিছু গাছ মরতে শুরু করেছে, কারণ বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে পানি নামতে পারছে না।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মমতাজ বেগম স্থানীয় পৌরসভাকে বাঁধটি অপসারণের নির্দেশ দেন। বাঁধটি অপসারণ না করায় শেষ পর্যন্ত শিবশারে জলোচ্ছ্বাসের অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে পারেনি।
তবে পাইকগাছা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী মো. রাজু হাওলাদার জানান, তারা শিবশারে এমন কোন বাঁধ নির্মাণ করেননি যা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত নয়।
আরও পড়ুন: শহররক্ষা বাঁধে ভাঙন: পাইকগাছা পৌরসদরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত