বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ নেবে না। তিনি বিশ্বের দেশগুলোর গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
রবিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক: উন্নত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে’ শীর্ষক সেমিনারের এসব কথা জানান মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
সেমিনারে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমাকে স্পষ্ট করে বলতে দিন: আসন্ন নির্বাচনে (বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে) কোনো পক্ষ নেবে না যুক্তরাষ্ট্র। আমরা কেবল একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রত্যাশা করি, যাতে বাংলাদেশিরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে; যে কে তাদের দেশ চালাবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
মার্কির রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত তিনটি ক্ষেত্রে আলোকপাত করতে চাই- নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, দুই দেশ গণতন্ত্রের প্রচার ও মানবাধিকার রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করতে পারে। তিনি স্বীকার করেন যুক্তরাষ্ট্র (নিজেও) নিখুঁত নয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে মার্কিন প্রতিবেদনের মান নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশ্ন
তিনি বলেন, আমরা আমাদের নিজেদের গণতান্ত্রিক নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এই যাত্রার মধ্যে রয়েছে পুলিশের জবাবদিহিতা বিষয়ে আমাদের নিজস্ব সমস্যা নিরসন এবং নির্বাচনের দিনে সকল আমেরিকান যেন ভোট দিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। সেইসঙ্গে আমরা সারা বিশ্বের দেশগুলোকেও তাদের গণতন্ত্র জোরদার করতে একই ধরনের অঙ্গীকার গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
হাস বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাবে মর্মে বিবৃতি দেয়ায় আমি সন্তোষ প্রকাশ করছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার রোধে এ আইন সংস্কারে আইনমন্ত্রীর সাম্প্রতিক প্রতিশ্রুতিকেও আমি স্বাগত জানাই।
রাষ্ট্রদূত বলেন, আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু নির্বাচনের দিন ভোটদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কার্যত, ইতোমধ্যেই নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য আবশ্যক হলো নাগরিকদের মত প্রকাশ, সাংবাদিকদের ভীতিহীন অনুসন্ধান এবং সুশীল সমাজের ব্যাপক পরিসরে জনমত গঠনের সুযোগ নিশ্চিত করা।
বর্ধিত নিরাপত্তা সহযোগিতা
হাস বলেন, আমরা আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে পারি। আমাদের দু’দেশের সরকার সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ করেছে। আগামী সপ্তাহগুলোতে আমরা আরও দুটি সংলাপ আয়োজন করবো।
এ সময় তিনি দুটি প্রস্তাবিত চুক্তির কথা বলেন- জেনারেল সিকিউরিটি অফ মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিএসওএমআইএ) এবং অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট (এসিএসএ)।
তিনি বলেন, জিএসওএমআইএ-এর আওতায় সামরিক ক্রয় সংক্রান্ত সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদানের মূলনীতি নির্ধারিত হবে। এই রূপরেখাটি বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনে অবদান রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির সহায়তায় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত হবে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, এসিএসএ-এর আওতায় আমাদের সামরিক বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় একে অপরকে সহায়তা দিতে পারবে এবং বিমান, যানবাহন বা নৌযান কোন সমস্যায় পড়লে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা খুচরা যন্ত্রাংশ ধার দিতে পারবে। কিংবা শুধু জ্বালানি ও খাদ্য বিনিমযয়ে সক্ষম হবে। ২০২০ সালে বিস্ফোরণের পর বৈরুত বন্দরে জাহাজ আটকে পড়া অথবা বঙ্গোপসাগরে যৌথ মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম চলাকালে নিরাপত্তা ও যৌথ কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টিতে এই এসিএসএ-এর একটি প্রায়োগিক প্রভাব রয়েছে। যেগুলো একটি ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে সক্ষম করার জন্য, প্রতিরক্ষা বাণিজ্যের সুযোগ সম্প্রসারণ, তথ্য আদান-প্রদান এবং সামরিক বাহিনীতে ‘অত্যাবশ্যক’।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতির প্রশংসায় মার্কিন অ্যাম্বাসেডর
জিএসওএমআইএ ও এসিএসএ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। এগুলো কারিগরি চুক্তি। এগুলো ‘জোট’ বা ‘সামরিক চুক্তি’র পর্যায়ভুক্ত নয় কিংবা এগুলো কোন বিস্তৃত ও অস্পষ্ট প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিও নয় যেমনটা ২০০২ সালে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছিল চীনের সঙ্গে। এগুলো কেবল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির উপাদান হিসেবে এবং আপনাদের নিজ প্রতিরক্ষা অভীষ্টকে এগিয়ে নিতে আপনাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা করবে। তাছাড়া এগুলো প্রচলিত বিষয়। ৭০টিরও বেশি দেশ আমাদের সঙ্গে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
তিনি বলেন, আইনপ্রয়োগ বিষয়ে, আমি সৎভাবে বলতে চাই। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ও জবাবদিহিতা ছাড়া র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই। আমরা এমন একটি র্যাব চাই যারা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে যেমন কঠোর থাকবে তেমনি কঠোর থাকবে মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রাখতে।
রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, কিন্তু র্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মানে এই নয় যে, আমরা জোরদার আইন প্রয়োগ বিষয়ে আমাদের ইতোমধ্যে স্থাপিত শক্তিশালী নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে পারবো না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদের দমন, সীমান্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং সহিংস চরমপন্থা প্রতিরোধে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাবো।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ দমন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন পুলিশ, সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ইউনিট এবং চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতামূলক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রস্তাবিত একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের মাধ্যমে এ কার্যক্রমগুলো বেগবান হবে এবং পুলিশকে নতুন সাজ-সরঞ্জাম অনুদান প্রদান ত্বরান্বিত হবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক
রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত।
আগামী মাসে আমি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির উদ্বোধনী সফরকে স্বাগত জানাবো।
তিনি ঘোষণা করেছেন যে এই গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্স থেকে এ যাবৎ সর্বপ্রথম পূর্ণকালীন অ্যাটাশেকে স্বাগত জানানোর ঘোষণা দিতে পেরে গর্বিত বোধ করছি। আমাদের দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে আমরা যে গুরুত্ব দিয়েছি তার অন্যতম প্রমাণ এই পদক্ষেপ।
তিনি বলেন, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বড় অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে সমান তালে প্রতিযোগিতা করবে। মেধাস্বত্ব অধিকার, সরবরাহ ব্যবস্থার সক্ষমতা, মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার সুযোগ এবং স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসা পরিবেশের মতো বিষয়গুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ যেভাবে ইন্টারনেট কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে সেটা বিদেশি বিনিয়োগ ও বিভিন্ন কোম্পানির বাংলাদেশে ব্যবসা করার আগ্রহকেও প্রভাবিত করবে বলেও জানান তিনি।
নতুন সুযোগ
রাষ্ট্রদূত বলেন, এছাড়া আরও অনেক সুযোগ আছে যার সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ, নতুন প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (ডিএফসি)-এর দক্ষিণ এশিয়াব্যাপী দূষণমুক্ত জ্বালানি, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যাঙ্কিংসহ বিভিন্ন খাতে চার বিলিয়ন ডলারের সক্রিয় অর্থায়ন রয়েছে।
আরও পড়ুন: মানবাধিকার প্রতিবেদন ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না: সালমান এফ রহমান
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত, শ্রম অধিকার না থাকায় যেমন বাংলাদেশ জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) বাণিজ্য সুবিধা পাবার যোগ্য হয়নি, ঠিক একই কারণে ডিএফসিও বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় অপারগ।
রাষ্ট্রদূত বলেন, আমাদের দুটি দেশ গত ৫০ বছরে একসঙ্গে একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছে। আমাদের দু’দেশের মানুষে-মানুষে বন্ধন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করে এবং তারা বিদেশি শিক্ষার্থীদের (যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া) মধ্যে ১৪তম এবং তাদের সংখ্যা দ্রুততম হারে বাড়ছে।
তিনি বলেন, এখন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। আমাদের অংশীদারিত্ব জোরদার করতে এবং আমাদের সম্পর্কের বিশাল সম্ভাবনা বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা নিতে প্রস্তুত। আমরা আপনাদের গতির সঙ্গে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত। ‘কারণটা সহজ, বদলে গেছে বাংলাদেশ।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি। আপনারা স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
হাস বলেন, এই পরিবর্তন এক গতিশীল নতুন সম্পর্ক নির্দেশ করে। সহজ কথায়, বড় বড় অর্থনীতি ও আঞ্চলিক পর্যায়ে নেতৃত্বশীল দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতি পরিচালনা করে ভিন্নভাবে।
বিআইআইএসএস-এর চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত কাজী ইমতিয়াজ হোসেনের সভাপতিত্বে সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান।