পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানব পাচার একটি আন্তঃসীমান্ত বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ। পাচারকারীরা একটি নির্দিষ্ট দেশে প্রযুক্তির ব্যবহারে ভাল হতে পারে এবং তাদের কাছে উন্নত প্রযুক্তি থাকতে পারে। আমরা আমাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছি যে, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সনদ ও উদ্যোগের মাধ্যমে মানব পাচার প্রতিরোধ করব।’
তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির মাধ্যমে মানব পাচারকারীরা আরও বেশি ক্ষতি করে। তবে সরকারি সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে পাচারকারীর প্রচেষ্টাকেও প্রতিহত করতে পারে।’
‘প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অপব্যবহার’-এই প্রতিপাদ্য নিয়ে শনিবার বিশ্ব মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস ২০২২- উদযাপিত হয়। দিবসটি উপলক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ইউএন নেটওয়ার্ক অন মাইগ্রেশন-এর ‘কাউন্টার ট্রাফিকিং ইন পার্সনস টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ’ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অপব্যবহারের প্রেক্ষাপটে মানব পাচার প্রতিরোধ বিষয়ে একটি জাতীয় পরামর্শ সভার আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে কোভিড-১৯-এর প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক মানব পাচারের প্রবণতা, পরবর্তী পরিস্থিতি এবং সাইবার স্পেসে মানব পাচারের বিষয়ে আলোচনা হয়।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশ সরকার, আন্তর্জাতিক অংশীদার, বেসরকারি খাত এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমের কর্মকর্তারা অংশ নেন। তারা মানব পাচার প্রতিরোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।
আরও পড়ুন: আরও ১ বছর ডি-৮ এর সভাপতি থাকবে বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বাংলাদেশ মানব পাচারের ক্ষেত্রে উৎস, ট্রানজিট ও গন্তব্য দেশ। যদিও বাংলাদেশ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ট্রাফিকিং ইন পারসনস প্রতিবেদন ২০২২ অনুয়ায়ী ‘টায়র ২’-এ অবস্থান করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধে অনেক ভাল উদ্যোগ নিয়েছে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘মানুষ পাচার একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এ বিষয়ে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। আমরা এই ভয়াবহ অপরাধের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছি। পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সব পক্ষের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। মানব পাচার প্রতিরোধে অনলাইনে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকার কাজ চালিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেনের মতে, ‘পাচারের শিকার ব্যক্তিরা শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হন। তারা হয়রানি, জোরপূর্বক শ্রম, জোরপূর্বক ও অবৈধ বিয়ে, মৃত্যুর মত পরিস্থিতিতে পরেন। সর্বস্তরে মানব পাচার প্রতিরোধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুস সালেহীন উল্লেখ করেন, ‘মানব পাচার রোধে বাংলাদেশ সরকারের যথেষ্ট আইন ও নীতি রয়েছে। এছাড়াও, অভিবাসন সংক্রান্ত গ্লোবাল কমপ্যাক্ট ব্যক্তি পাচার নির্মূল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এখন জাতীয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে এই আইন ও কমপ্যাক্টের কার্যকর বাস্তবায়ন করে, মানব পাচারের মত জঘন্য অপরাধের অবসান ঘটাতে হবে।’
প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধীরা মানব পাচারের কার্যক্রম জোরদার করছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগীদের নিয়োগ, শোষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পাচারকারীরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নানা টুল ব্যবহার করছে। এছাড়া পাচারকারীরা সহজে ভুক্তভোগীদের পরিবহন, বাসস্থান, বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রলোভন দেখানো, অন্য পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগেও প্রযুক্তির সহযোগিতা নিচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাচারকারীরা পরিচয় গোপন করছে। দ্রুত গতিতে এবং অল্প খরচে যোগাযোগ করতেও প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে তারা।
আরও পড়ুন: বন্যা থেকে বাঁচতে নদীগুলো খনন করতে হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস উল্লেখ করেন, ‘প্রযুক্তি পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবেও অনেক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। মানব পাচার নির্মূলের প্রচেষ্টায় ভবিষ্যত সাফল্যের জন্য আইন প্রয়োগকারী এবং অপরাধমূলক বিচার ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
আইওএম বাংলাদেশ-এর মিশন প্রধান এবং বাংলাদেশ ইউএন নেটওয়ার্ক অন মাইগ্রেশনের সমন্বয়কারী আবদুসাত্তর এসয়েভ বলেন, ‘ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ ব্যবহারের ওপর প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম করলে মানব পাচারের ঝুঁকি কমবে। মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধে সহায়তার জন্য টেকসই প্রযুক্তি-ভিত্তিক সমাধানে বেসরকারি খাতের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। যার মাধ্যমে আমরা বেসরকারি খাতের উদ্ভাবন ও দক্ষতা কাজে লাগাতে পারি।’
প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বিদেশ যান। যাদের মধ্যে অনেকেই পাচারকারীদের লক্ষ্যবস্তু হন। কোন কোন অভিবাসী ঋণ, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন শোষণ, জোরপূর্বক বিয়ে এবং আধুনিক দাসত্বের শিকার হন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন, বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স জেরেমি ওপ্রিটেসকো, বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ অব মিশন স্কট ব্র্যান্ডন এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর