প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাসহ নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।
প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে অবিলম্বে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন কবে হবে তার একটি রোডম্যাপ দিতে বলেছি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানসহ বেশকিছু বিষয়ে তাদের উদ্বেগ নিরসনে জরুরি পদক্ষেপ চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি আরও বলেন, তারা ভারত থেকে শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডের প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির সংলাপ শেষে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানতে নতুন পর্যায়ের সংলাপ শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রথমে সংলাপে বসে বিএনপি।
বিএনপির ছয় সদস্যের দলের নেতৃত্ব দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংলাপে সংস্কার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সহ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বিএনপি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে হলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, ড. আব্দুল মঈন খান এবং সালাহউদ্দিন আহমদ।
ঘণ্টাখানেক বিএনপির সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা আমীর ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
ফখরুল বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিতর্কিত কেউ যেন নির্বাচন সংস্কার কমিশনে না যান। আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারের জাল ভোটে নির্বাচিত সব ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করতে বলেছি। ভুয়া, ব্যর্থ ও পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচনের অভিযোগে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের সঙ্গে থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছি।’
ফখরুল আরও বলেন, 'তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের জানিয়েছেন, নির্বাচন আয়োজন করা তার এক নম্বর অগ্রাধিকার।’
বিএনপির দাবির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা কী বলেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। তারা মনে করে আমাদের দাবি জনগণের দাবি, আমাদের দাবিও তাদের।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের 'এক-দু'জন' সদস্যকে অপসারণ করার দাবিও জানিয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে দু-একজন ব্যক্তি আছেন, যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল চেতনা ও গণঅভ্যুত্থানকে বাধাগ্রস্ত করছেন। আমরা তাদের অপসারণের দাবি জানিয়েছি।
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে 'নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল' করার পেছনে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে দলটি।
ফখরুল বলেন, কিছু আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা ও মন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তারা কীভাবে পালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের সাহায্য করছে কারা- এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন।
তিনি আরও জানান, গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য ও নিরপেক্ষ প্রার্থী নিয়োগ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে বিএনপি।
হাইকোর্ট বিভাগে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি উল্লেখ করে দলের বিচারকদের অপসারণের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুটিও উত্থাপন করে এটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের খুঁজে বের করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগ বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে সহযোগিতা করছে না বলে অভিযোগ করেন বিএনপির এই নেতা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের একটি সত্যানুসন্ধানী দল সাম্প্রতিক বিক্ষোভ থেকে উদ্ভূত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করছে।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের দায়িত্ব হলো সত্য প্রতিষ্ঠা, দায়িত্ব চিহ্নিতকরণ, মূল কারণ বিশ্লেষণ এবং অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘন মোকাবিলা ও এর পুনরাবৃত্তি রোধে বাংলাদেশের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রণয়ন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, সবাই নয়, কিছু লোক পরিকল্পিতভাবে জনগণকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং বিএনপি এটিকে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মনে করে সরকারের পদক্ষেপ কামনা করেছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে সংলাপে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'সংলাপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ছয়টি সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকে জানানো এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা ও তাদের পরামর্শ নেওয়া।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দুই দফা সংলাপ হয়।
অন্তবর্তীকালীন সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।
বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সরফরাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন, টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশন, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রিয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে।