রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের প্রতি মালয়েশিয়ার জোরালো সমর্থনের প্রশংসা করা হয়েছে একটি ওয়েবিনারে। এছাড়া এতে দুটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সাধারণ ঐতিহ্য ও অত্যন্ত সুসম্পর্কের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সম্পর্ক: ভবিষ্যতের জন্য পূর্বাভাস’ শিরোনামের ওয়েবিনারটি কসমস ফাউন্ডেশন, কসমস গ্রুপের জনহিতকর শাখা আয়োজন করেছে।
ওয়েবিনারে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন কসমস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাহার খান।
এতে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড.ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী এবং প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো.হাশিম।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংলাপটির প্রিমিয়ার হবে।
এ সময় প্যানেল আলোচক ছিলেন রাষ্ট্রদূত (অব.) ফারুক সোবহান, ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (আইএসআইএস) এর ফরেন পলিসি অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ প্রোগ্রামের গবেষক ইয়ানিথা মীনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর।
সভাপতি ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘অভাবনীয়’ বলে বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, আমরা আসিয়ানের পাশাপাশি অন্যান্য আঞ্চলিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে গভীর মনোযোগ দেয়ার জন্য মালয়েশিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্ক নিয়ে কসমস ফাউন্ডেশনের ওয়েবিনার বৃহস্পতিবার
এ সময় সাবেক এই উপদেষ্টা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের প্রশংসা করেন।
তিনি জাতিসংঘের গণহত্যা বিষয়ক রেজুলেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতিগত নিধন ও অন্যান্য অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের ‘সুরক্ষা দানের দায়িত্ব’ এর ওপর আলোকপাত করেন।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সম্পর্কের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ ও ইউরোপের সাম্প্রতিক সংকটের পর একটি নিয়মতান্ত্রিক বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের টিকে থাকা নিশ্চিত করতে দুই দেশকে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।
মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ তার বক্তব্যে জোর দিয়ে বলেন, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের উচিত দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান শক্তিশালী সম্পর্ককে আরও বৃদ্ধি করা।
তিনি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পর্যটনের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহায়তায় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা স্মরণ করেন।
হাইকমিশনার আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার ৩০তম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং তারা দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ আগামী পাঁচ বছরে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা প্রকাশ করেন হাজনাহ।
চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে, তিনি বিশ্বাস করেন, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও বৈচিত্র্যময় করার জন্য একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা উচিত।
মালয়েশীয় হাইকমিশনার প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা ও খাদ্য নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এ খাতগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলেন।
রোহিঙ্গা ইস্যু সম্পর্কে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুকে বহুপক্ষীয় ফোরামে উত্থাপনে বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী সমর্থক হিসেবে পাশে থাকবে মালয়েশিয়া।
বক্তব্যে ফারুক সোবহান বলেন, বাংলাদেশকে তার ‘লুক ইস্ট নীতি’তে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমার দৃষ্টিতে এই ‘লুক ইস্ট নীতি’র কেন্দ্রবিন্দু আসিয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক।
আরও পড়ুন: ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে যাচ্ছে দেশ: টিআরএনবি ওয়েবিনারে বক্তারা
অতীতের উল্লেখযোগ্য যুগান্তকারী দ্বিপক্ষীয় সফরের কথা স্মরণ করে ফারুক সোবহান এ ধরনের মিথষ্ক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
ড. ইমতিয়াজ পারস্পরিক সহযোগিতাকে আরও সুসংহত করার জন্য ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’-এর মতো দুই দেশের মধ্যে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম চালু করার প্রস্তাব করেন।
তিনি বলেন, এটা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হতে পারে। এতে যোগ দেয়ার জন্য আমরা কিছু বেসরকারি উদ্যোক্তাকেও আমন্ত্রণ জানাতে পারি।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরও বৃদ্ধি করতে এফটিএ এবং বিশাল আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বা আরসিইপির বিষয়টি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ এশিয়ান দেশগুলো আরসিইপি-তে যোগ দিচ্ছে। আশা করা হচ্ছে এশিয়ার এই ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশগুলো আগামী দশকে বিশ্ব বাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে।
তিনি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আইন মেনে স্বচ্ছ, ন্যায্য ও নিরাপদ অভিবাসনের কথা উল্লেখ করেন।
মালয়েশিয়ার গবেষক ইয়ানিথা মীনা বলেন, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ শ্রম নিয়োগ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে; যা এই দুই বন্ধু দেশের মধ্যকার সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তিনি বলেন, এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং বিষয়টি আমাদের সম্পর্কের মধ্যে বহুল সমাদৃত হয়েছে। তবে অন্য সব বিষয়ের মতো শ্রম সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
কসমস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাহার খান বলেন, ঢাকা ও কুয়ালালামপুর কীভাবে অর্ধ-শতাব্দী ধরে সত্যিকারের ‘সব সময়ের’ বন্ধু ও মিত্র হিসেবে রয়ে গেছে তা গুরুত্বপূর্ণ।
এ সময় তিনি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা ও সেবা প্রদানে মালয়েশিয়ার ভূমিকার প্রশংসা করেন।
নাহার খান বলেন, বাংলাদেশ আশা করে মালয়েশিয়া মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখবে। যাতে তারা তাদের দেশের নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।
তিনি বলেন, এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এই দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করার এটাই সঠিক সময়।
নাহার খান বলেন, সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সম্পর্কের নতুন মাত্রা হিসেবে ঢাকা ও পুত্রজায়ার মধ্যে সামুদ্রিক আদান-প্রদান বৃদ্ধি করার এখনই উপযুক্ত সময়।
তিনি আরও বলেন, এজন্য সামুদ্রিক সম্পৃক্ততা শুরু করার ক্ষেত্র হিসেবে বঙ্গোপসাগর এবং আঞ্চলিক অন্যান্য জলসীমা ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ ভারত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলের প্রতিযোগিতামূলক সামুদ্রিক অঞ্চল হিসেবে ইতোমধ্যে এগুলোর গুরুত্ব রয়েছে।
সংলাপে বক্তারা একমত হন যে কসমস ফাউন্ডেশনের আয়োজিত এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও মতবিনিময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিস্তৃতি ও গভীরতাকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করবে।
আরও পড়ুন: ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নিয়ে কসমস ফাউন্ডেশনের ওয়েবিনার শনিবার