বিদেশ থেকে ভিডিওতে জীবন বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে আলোচিত হওয়া সুমি শুক্রবার সকালের ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছান। বিকালে তাকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।
পরে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ হাসান ও পাঁচপীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবীর বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা মল্লিকা বেগমের কাছে সুমিকে হস্তান্তর করেন। এরপর ঢাকা থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সে করে সুমি বাবা-মায়ের সাথে বৈরাতি সেনপাড়া গ্রামে যান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে উপস্থিত সাংবাদিকদের সুমি জানান, তিনি দুই বছর আগে ঢাকায় গিয়ে পোশাক কারাখানায় যোগ দেন। সেখানে আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার যুবক নুরুল ইসলামের সাথে তার পরিচয় হয় এবং পরে তারা বিয়ে করেন। ৩০ মে স্বামী নুরুল ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজ’র মাধ্যমে গৃহকর্মী ভিসায় তাকে সৌদি আরবের রিয়াদে পাঠায়।
সেখানে যাওয়ার পর প্রথম কর্মস্থলে মালিক সুমিকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতেন। হাতের তালুতে গরম তেল ঢেলে দিতেন ও কক্ষে আটকে রাখতেন। এক পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে মালিক তাকে ইয়ামেন সীমান্তের এলাকা নাজরানের এক ব্যক্তির কাছে প্রায় ২২ হাজার রিয়ালে বিক্রি করে দেন। ওই মালিকও তাকে নির্যাতন করতেন।
উদ্ধার হওয়ার আগে সুমিকে ১৫ দিন ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। ঠিকমতো খাবার দেয়া হয়নি। তার নিজের মোবাইল ফোনটিও তারা নিয়ে নিয়েছিল। এক সময় খুব কান্নাকাটি করে স্বামীর সাথে একটু কথা বলার জন্য মোবাইলটি চেয়ে নেন সুমি। পরে বাথরুমে গিয়ে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে নির্যাতনের কথা জানিয়ে সেই ভিডিও স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন তিনি। ভিডিওটি তার স্বামী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন এবং গণমাধ্যমকর্মীদের জানান। বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সুমিকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয় এবং সৌদিতে নিযুক্ত বাংলাদেশি কনসুলেট আবদুল হক দেশটির পুলিশের সহযোগিতায় সুমিকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
সৌদি যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকেই নির্যাতন শুরু হয় জানিয়ে সুমি বলেন, ‘আমি যেভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছি তা সবাই ভিডিওর মাধ্যমে জেনেছেন। আর নতুন করে কিছু বলতে চাচ্ছি না। ওখানে আমার ওপর কী ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে এটা আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। প্রতি রাতেই শরীরের ওপর চলত নির্যাতন। প্রতিবাদ করলেই মারধর। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। কিন্তু তাতে তারা থেমে যেত না। ওই অবস্থায় শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। জ্ঞান ফিরলে সেটা বুঝতে পারতাম।’
‘কাজ করতে গিয়ে কেন আমাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হলো’- প্রশ্ন করেন সুমি।
দিনমজুর রফিকুল ইসলামের চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় সুমি জানান, দুই বছর আগে আশুলিয়ার নুরুলের সাথে বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন যে আগেও একটি বিয়ে করেছেন তার স্বামী। শেষে বাধ্য হয়ে সতিনের সাথে সংসার শুরু করেন। বিয়ের দেড় বছর পর তার একটি সন্তান হয়। সতিনের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ও সন্তানকে মানুষ করার স্বপ্নে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুমি। এ উদ্দেশ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে গৃহকর্মীর প্রশিক্ষণ শেষ করেন তিনি। তাকে বিনামূল্যে সৌদি আবর পাঠানোর লোভ দেখায় দালালরা। পরে মে মাসে সৌদিতে পাড়ি জমান তিনি।
সুমির মা মল্লিকা বেগম বলেন, ‘ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর একদিনও স্বস্তিতে ঘুমাতে পারিনি। আমরা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এখন মেয়েকে ফিরে পেয়েছি আর কিছু চাই না।’
বাবা রফিকুল বলেন, ‘অভাব অনটনের সংসারে কিছু টাকা কামানোর জন্য বিদেশে গিয়েছিল মেয়েটা। কোনোদিন ভাবতে পারিনি এমন অবস্থার শিকার হতে হবে আমার মেয়েকে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ হাসান জানান, পরবর্তীতে সুমির কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।