চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষর (সিডিএ) উদ্যোগে, নগরীর লালখান বাজার থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘে্যর এ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। তবে এক্সপ্রেসওয়ের বাইরে র্যাম্প ও লুপসহ এটির দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ২০ কিলোমিটার।
গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সিডিএ সূত্রে ধারণা দেয়া হয়েছে প্রকল্প সম্পন্ন করতে আরও সময় লাগতে পারে।
সরকারের অন্যতম বৃহৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিশ্বমানের নগরীর দিকে চট্টগ্রাম আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সেই সাথে মীরসরাই ও আনোয়ারার অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চালু হলে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নগরীর তালিকায় স্থান করে নেবে বলেও আশা তাদের।
তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ মূলত শুরু হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের সিমেন্ট ক্রসিং থেকে কাঠগড় পর্যন্ত প্রায় ৬০টি পিলারের পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে এবং পাঁচটি ‘টেস্টপাইল’ সম্পন্ন হয়েছে।
এছাড়া ওই এলাকায় নিরাপত্তা ‘ফেন্সিংয়ের’ বাইরে প্রয়োজনীয় দুই লেনের রাস্তা রাখার জন্য প্রায় দুই কিলোমিটার কার্পেটিংসহ রাস্তা প্রশস্তকরণ কাজ শেষ হয়েছে। আর রাস্তার দুই পাশে ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণের কাজ চলছে। পাশাপাশি লালখান বাজার থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত প্রায় ৪৫০টি মাটি পরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে।
নির্মিতব্য এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচে থাকবে আগ্রাবাদ, ইপিজেড, বন্দর ও কাস্টমসের মতো ব্যস্ততম এলাকাগুলো। তাই এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে বিকল্প সড়ক প্রস্তুত করার পরামর্শ দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে ঘিরে সরকারের যে বড় উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে দেশের অর্থনীতিতে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ জানান, এতে করে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা বন্দর সংশ্লিষ্ট কাজে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে ও গতিশীলতা সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে একের পর এক অনেকগুলো বৃহৎ বৃহৎ প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের তিনটি বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করেছেন।’
‘চাক্তাই কালুরঘাট রিভার ড্রাইভ রোড, বে টার্মিনাল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ শুরু চট্টগ্রামের উন্নয়নের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়,’ যোগ করেন তিনি।
যে কারণে নির্মিত হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে
এটি নির্মিত হলে নগরীর বহদ্দারহাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত পুরো সড়কের ওপর ফ্লাইওভার থাকবে। দীর্ঘদিন ধরে যানজটে নাকাল বিমানবন্দর, সমুদ্র বন্দর ও ইপিজেড সংশ্লিষ্ট পতেঙ্গা, হালিশহর এলাকার মানুষ নতুন দিনের নতুন আলোয় উদ্ভাষিত হবে। যে পথ যেতে এখন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়নে সে পথ যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ মিনিট।
সিডিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মূলত বিমানবন্দরগামী যাত্রীদের নির্বিঘ্নে যাতায়াত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি নির্মিত হলে শহর থেকে বিমানবন্দরে পৌঁছতে মাত্র ১০ মিনিট সময় ব্যয় হবে।
তাছাড়া, এক্সপ্রেসওয়ে হলে চট্টগ্রাম বন্দর, ইপিজেডসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের পণ্য পরিবহন আরও নির্বিঘ্ন হবে। কারণ বিমানবন্দর ও তত্সংলগ্ন এলাকার যানবাহনসমূহ এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করবে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান জানান, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার জন্য আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অত্যাধুনিক ‘গার্ডার লিফটিং’ প্রযুক্তির ব্যবহার করে এটি নির্মাণ করা হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আগামী ৫ বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণ ক্ষমতা ও কার্যক্রম দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে না হলে চট্টগ্রাম পিছিয়ে পড়তো।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশের ৪০ ভাগ গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হতো। কিন্তু মহানগরের ভেতরে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা না থাকায় গত ১০ বছরে বিদেশি ক্রেতা কমেছে। বিমানবন্দর থেকে শিল্পাঞ্চল, কালুরঘাট, ফৌজদারহাট, নাসিরাবাদ যেতে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ফলে চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি আগের ৪০ ভাগ থেকে কমতে কমতে এখন ১০ ভাগে নেমে এসেছে। যার একমাত্র কারণ যোগযোগ ব্যবস্থা।
বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘ঢাকা থেকে বিমানে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আসতে সময় লাগে ৪০ মিনিট। ব্যাংকক থেকে পৌনে ২ ঘণ্টা। আর সেই বিমানবন্দর থেকে নাসিরাবাদ, ফৌজদারহাট আসতে সময়ে লাগে ৩ -৪ ঘণ্টা। যার কারণে গত ১০ বছরে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি।’
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি চট্টগ্রামের জন্য অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি নির্মিত না হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অবস্থা আরও করুণ হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর, বিমানবন্দসহ সব বিষয় বিবেচনায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসটি চট্টগ্রামের জন্য অপরিহার্য ছিল।
এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে ম্যাক্স-রেনকিন: সিডিএ সূত্র জানায়, গত ২৪ জুন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের দরপত্রের ‘ফিন্যান্সিয়াল অফার’ খোলা হয়েছিল। সেখানে ম্যাক্স-রেনকিন নামের একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে।
মূলত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য ১০টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। তার মধ্যে ৬টি প্রতিষ্ঠান কারিগরিভাবে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যোগ্য বিবেচিত ৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান চীনা ও অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে টেন্ডার দাখিল করে (কারণ দেশীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের এককভাবে এ ধরনের বড় কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই)। চীনা অন্য ৩টি প্রতিষ্ঠান এককভাবে দরপত্র দাখিল করে।
এছাড়া চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো কোম্পানি লিমিটেড, সিচুয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশন লিমিটেড, আব্দুল মোনেম জেবি ও হেগো তমা মীর আখতার জেভি দরপত্রে অংশ নিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর একনেকে অনুমোদনের পর ওই বছরই ৩১ অক্টোবর এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং পরে জমি অধিগ্রহণসহ দাপ্তরিক কাজ শেষে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে ২০১৩ সালে প্রথম উড়াল সড়কের যুগে প্রবেশ করে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। নগরীর কালামিয়া বাজার থেকে শুরু হয়ে বহদ্দারহাট মোড় ছাড়িয়ে প্রধান সড়কেই নামানো হয় প্রথম ফ্লাইওভারটি। এরই ধারাবাহিকতায় মুরাদপুর থেকে শুরু হয়ে লালখান বাজার ও কদমতলীতে আরো দুটি ফ্লাইওভার নির্মান করে সরকার। শুরুতে এসব ফ্লাইওভারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এখন প্রকল্পগুলোর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থায়।