বিশেষজ্ঞদের মতে, সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এ মৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব না। এজন্য প্রয়োজন শিশু সুরক্ষায় বন্যাকালীন সময়ে নিরাপদ ব্যবস্থাপনা।
জেলায় গত ৫ বছরে শুধু বন্যার সময় পানিতে ডুবে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে যার ৫৮টিই শিশু। তবে, সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো এরইমধ্যে চলতি বছর বন্যার পানিতে ডুবে ১৫ শিশুসহ মোট ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কুড়িগ্রাম ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ সূত্রে জান যায়, ২০১৯ সালের বন্যায় জেলায় ২১ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে শিশু ছিল ১৬টি। এর আগের বছর পানিতে ডুবে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে শিশু ছিল ২০টি। বন্যায় ২০১৬ সালে মারা যাওয়া ৮ জনের মধ্যে শিশু ছিল ৬টিন। আর ২০১৫ সালে একটি শিশু মারা যায়।
সরকারি দপ্তরের এসব তথ্য বিশ্লেষেণ করলে দেখা যায়, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশুরা।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের গত ২০ জুন থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে মারা যাওয়া ২০ জনের মধ্যে ৬টি কন্যা শিশু ও ৯টি ছেলে শিশু রয়েছে।
পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান দাবি করেন, শুধুমাত্র জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ মৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব।
তিনি বলেন, এ জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সকল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মী চিকিৎসা সেবা দেয়ার পাশাপাশি শিশুদের সতর্ক রাখতে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
তবে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ প্রচার চালালে চলবে না। জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, জনপ্রতিনিধিসহ সকলের সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে সচেতনতার কাজটি করতে হবে। তা হলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে, যোগ করেন তিনি।
কুড়িগ্রাম শিশু ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহানা আক্তার বলেন, বন্যার মধ্যে অবহেলা ও খেয়ালিপনার কারণে হয়তো এমনটি ঘটছে। তবে, সচেতনতা বৃদ্ধির পরেও চ্যালেঞ্জ হলো দুরন্তপনা শিশুদের আগলে রাখা। আমরা আমাদের সকল কাজের সাথে শিশু সুরক্ষার সচেতনতার প্রচার অব্যাহত রেখেছি।
বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) আফাদের নির্বাহী পরিচালক সাইদা ইয়াসমিন জানান, বন্যা কবলিত শিশুদের সুরক্ষায় দৃশ্যমান কোনো কাজ নেই। সবার দৃষ্টি ভয়াবহ বন্যার দিকে। শিশু মানবসম্পদ রক্ষায় জিও কিংবা এনজিও কারোরই সুনির্দিষ্ট করে প্রকল্প, বাজেট কিংবা পরিকল্পনা নেই। সবার দৃষ্টি রিলিফ, ভাঙন প্রতিরোধ, উদ্ধার ও পরিবারের অন্যান্য সম্পদ রক্ষায়।
পরিবারের সকল সদস্য সজাগ থাকলে ও বাড়ির শিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলে এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। শিশুদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বছরব্যাপী বিভিন্ন কাজ করতে হবে, যোগ করেন তিনি।
সলিডারিটি এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম হারুরন অর রশিদ লাল উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রিয় শিশুদের বাঁচাতে হবে। বন্যা আসার আগেই শিশুদের রক্ষায় নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে হবে। পরিবার ও প্রতিবেশীদের সবাইকে কাউন্সিলিং করতে হবে। নিতে হবে বন্যা কবলিত শিশুদের সুরক্ষায় নিরাপদ ব্যবস্থাপনা।
জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা এম এ বকর জানান, আমাদের কাজ মূলত শহর কেন্দ্রিক। শিশু শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন দিবস কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। মাঠ পর্যায়ে শিশু সুরক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি কিংবা অন্য কোনো কাজ নেই।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে ব্যাপক গণসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম জানান, এখন পর্যন্ত যে সব শিশুর মৃত্যু হয়েছে তাদের অধিকাংশের বয়স ৫ বছরের নিচে। তাদের সাঁতার শেখার বয়সও হয়নি। কাজেই এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতার বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ নেই। আমরা জেলায় সরকারের সকল দপ্তর ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেব। যাতে আগামীতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমে আসে, যোগ করেন জেলা প্রশাসক।