শুধু সীমান্ত নদী যাদুকাটাই নয়! পাশাপাশি সীমান্তের ১৮টি ছড়া থেকেও কয়লা কুড়িয়ে জীবনযাপন করছেন ওইসব শ্রমিকরা। এ কাজের মাধ্যমে প্রায় অর্ধসহস্রাধিক নারী শ্রমিক হয়ে উঠেছেন আত্ম-নির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী।
জানা যায়, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলাটি অবস্থিত। সুনামগঞ্জ জেলার ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সু-উচ্চ মেঘালয় পাহাড় ঘেষা সীমান্ত লাগোয়া একটি জনপদের নাম তাহিরপুর। এ জনপদের বেশির ভাগ জনসাধারণ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত।
প্রতিবছর বর্ষায় ভারত থেকে প্রবাহিত স্রোতধারায় যাদুকাটা ও সীমান্ত ছড়াগুলো দিয়ে বালুর সাথে মিশে থাকা কয়লা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে কয়লা তোলার পর প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পানির স্রোতের সাথে নুড়ি, বালুমিশ্রিত কয়লা যাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ ও সীমান্ত ছড়াগুলোর পানিতে দেখা যায়।
সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রধান জীবিকা হলো যাদুকাটা নদীতে ভারত থেকে প্রাকৃতিকভাবে পানির স্রোতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নেমে আসা বালুর সাথে মিশে থাকা কয়লা কুড়ানো। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুখর যাদুকাটা নদীর উৎসমুখ থেকে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত এ নদীতে প্রতিদিন এ কাজ করে থাকে লক্ষাধিক শ্রমিক।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কয়লা শ্রমিকদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী। তারা বালুমিশ্রিত কয়লা প্রথমে ঠেলা জালিতে তুলে ও পানিতে ছেঁকে বালু থেকে আলাদা করে বস্তায় ভরে রাখে। পরে প্রতি বস্তা কয়লা সাড়ে তিনশ থেকে চারশ টাকা দরে স্থানীয় কয়লা মহাজনদের কাছে বিক্রি করে।
২৮ বিজিবি সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়ন নিয়ন্ত্রিত লাউড়েরগড় বিওপি ক্যাম্প ও গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত এ নদীতে তাহিরপুরসহ পার্শ্ববর্তী জামালগঞ্জ ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কমপক্ষে ১০ হাজার শ্রমিক প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু কয়লা কুড়ানোর কাজে নিয়োজিত। এদের বেশিরভাগই নারী শ্রমিক। নদীর তীরবর্তী লাউড়েরগড়, ডালারপাড়, ছড়ারপাড়, পুরানলাউড়, মোকশেদপুর, মানিগাও, মাহারাম বড়গোপ, রাজারগা, জামবাক, কড়ইগড়া, চানপুর, রজনীলাইন, রাজাই, শরিফগঞ্জ, মাছিমপুর, চিনাকান্দি ও ছাতারকোনা গ্রামের নারীরাই এ কাজে বেশি নিয়োজিত।
কয়লা শ্রমিকরা জানান, যে সকল হতদরিদ্র শ্রমজীবী নারীরা কাজের অভাবে দিনের পর দিন অনাহারে অর্ধাহারে থাকত, তাদের অনেকেই এখন কয়লা কুড়িয়ে স্বাবলম্বী। প্রতিদিন পাঁচশ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত উপার্জন করতে পারেন তারা। আবার কাজের দক্ষতা অনুযায়ী কয়লা মহাজনরা অগ্রিম টাকাও দিয়ে থাকেন অনেককে।
মানিগাও গ্রামের জরিনা, লাউড়েরগড় এর কুলসুমা, রাবেয়া, মাহারাম এর সোনাবান, রাজাই গ্রামের তরী হাজং এর মতো অনেক শ্রমজীবী নারীরা কয়লা কুড়িয়ে সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। অনেক শ্রমজীবী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা এখন স্কুল-কলেজেও লেখাপড়া করছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার স্বরুপগঞ্জ গ্রামের কয়লাশ্রমিক জান্নাত আরা বলেন, 'আমি আর ২ পুলা (ছেলে) মিল্লাই (মিলে) গত ৬ মাস কয়লা তুইল্লা (তুলে) বিক্রি করে ৩ লাহক (লাখ) টাকা কামাইছি (রোজগার করেছি)। সেই টাহা (টাকা) দিয়া দুই পুলারে (ছেলেকে) বিয়া (বিয়ে), টিনের ঘর করছি (নির্মাণ)। গরু-ছাগল কিনে আমরা এহন সুহেই (সুখে) থাকতাছি (আছি)।’
জান্নাত আরার মতো সীমান্তবর্তী কয়েক হাজার শ্রমজীবী পরিবার প্রকৃতির করুণায় বদলে দিয়েছে তাদের জীবনমান। তারা পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাতে পারছেন।
স্থানীয় বাদাঘাট ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আপতাব উদ্দিন বলেন, ভারত থেকে পানির সাথে বাংলাদেশে নেমে আসা বালুমিশ্রিত কয়লা আমাদের তাহিরপুর উপজেলাসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি উপজেলার জন্য আল্লাহর দান। আগে আমাদের এলাকার বেশিরভাগ শ্রমিক পরিবার জীবন কাটাত অর্ধাহারে-অনাহারে। আর এখন ওই বালির সাথে মিশে থাকা কয়লা তুলে হাজার শ্রমিক বেঁচে আছেন।
এ ব্যাপারে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধ চৌধুরী বাবুল বলেন, প্রবাহমান যাদুকাটা নদীতে স্রোতের সাথে বালুমিশ্রিত কয়লা ঠেলা জালিতে ছেঁকে প্রক্রিয়া করে আলাদা করে বস্তায় ভরে মহাজনদের কাছে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা একটি অদ্ভুত ও কঠিন কাজ বটে। তবুও এলাকায় অন্য কোনো কাজ না থাকায় আমার উপজেলার শ্রমজীবী লোকজন নদীর স্রোতের সাথে সাথে নিজেদের জীবনযাত্রা পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
শ্রমিকদের কঠিন কাজে তার উপজেলা পরিষদের সক্রিয় সহযোগিতা রয়েছে বলে জানান তিনি।