ইতিহাসের অধিকাংশ মহান নারী ও পুরুষ, বিশেষ করে যারা একই সাথে বড় নেতা ছিলেন তাদের মাঝে এ তিনের একটি বা একাধিকের নজির পাওয়া যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন পর্যালোচনা করলে, যার জীবন আপনি যেদিক থেকেই দেখুন না কেন, ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক, আমরা দেখি যে এ তিনটি বিষয়ের যেখানে অমিল তা হলো এক সহজ-সরল হিসেব; তিনি রাজনীতিময় জীবনযাপন করেছিলেন তার জনগণের জন্য।
এটি তার রাজনৈতিক শিক্ষার শুরু থেকেই একক-সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য ছিল যা শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। এ বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবির উপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাদের কাছে যান বঙ্গবন্ধু যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। তখন তার বয়স খুব বেশি হলে ১৮ হবে। তাঁর এই কাজ অব্যাহত ছিল সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর বছর ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। শতাব্দীর শেষভাগে তাঁদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা বাংলার মানুষের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে প্রমাণিত হবে সেটি জানতেন তাঁরা। স্বাধীনতার সময়ে প্রায় সাড়ে সাত কোটি (বর্তমানে ১৬ কোটিরও বেশি) মানুষের দেশ-রাষ্ট্রের জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসের অনুমানে তাঁর পরামর্শদাতাদেরও ছাড়িয়ে যেতে পারেন বলে মনে করা যেতে পারে।
উল্লেখযোগ্যভাবে সোহরাওয়ার্দীর নামটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রকাশিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র দ্বিতীয় প্যারায়, কিছু অসন্তুষ্ট সেনা কর্মকর্তার হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ৩৫ বছর পর। এতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিজের ছোট্ট কক্ষে আবদ্ধ হয়ে কথাগুলো লিখে, বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দীকে তাঁকে ‘রাজনৈতিক জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়’ শেখানোর জন্য কৃতিত্ব দেন। তবুও প্রশ্ন থেকে যায় যে, সম্পর্ক নেই এমন কারও প্রতি কি কাউকে সহানুভূতি বোধ করানো শেখানো যেতে পারে? আপনি কি অন্যের ওপর অন্যায় দেখে ক্রোধের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন? বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপরে তাঁরা যে ধরণের প্রভাব ফেলেছিল তা আমরা তাঁর যাপিত জীবনের পথে দেখেছি, কারণ এসব প্রবৃত্তি সাধারণত মানুষের জন্মগত হতে হয়।
এগুলো তিনি নিজে লিখেছেন, যদিও তারা তাঁর জীবনের অল্প সময়ই সাথে থাকতে পেরেছেন- ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত; যেখানে আমরা মানবতার সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত পাই তাঁর সহকর্মী পুরুষ এবং নারীদের সাথে একসাথে থাকার এক অবিরাম অনুভূতি, তাদের নেতা হওয়া সত্ত্বেও। এটি ছিল বঙ্গবন্ধু- বাংলার বন্ধু হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাঁর কথা ও কর্মের মূল বৈশিষ্ট্য। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৯৬৬-৬৯ সাল পর্যন্ত কারাবাসের পর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। উপাধি ঘোষণা দিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ। এ সভায় রাখা বক্তৃতায় শেখ মুজিব ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগার দফা দাবির পক্ষে তাঁর পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
একজন মহান নেতার জন্য জনগণের বন্ধু উপাধিতে ভূষিত হওয়ার চেয়ে আর বড় স্বীকৃতি কী হতে পারে? একটি ডাকনাম নিজেই ইতিহাসের পাতাগুলোর মধ্যে এক ধরণের স্বতন্ত্র স্থানকে বোঝায় এবং এটি প্রায়শই মহিমান্বিত হতে পারে, এক্ষেত্রে আপনি কেবল এটি শুনেই বুঝে যেতে পারেন যে এটি কখনও মিথ্যা হতে পারেনা। আর বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে তা সময়-পরীক্ষিত সত্য। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে এখন আমাদের প্রায় পঞ্চম দশকে এসেও এটি লক্ষণীয় যে কীভাবে আমাদের সমাজ এখনও স্ব-মূল্যবোধের ধারণা নিয়ে চলে এবং এগুলো সামন্ততান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক অতীতের চূড়ান্ত অবশিষ্টাংশ।
বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর মানুষেরা এতোই মূল্যবান যা আপনি কখনই তাঁর কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবেন না। আপনি এটি কেবল তাঁর কর্ম থেকে শিখতে পারেন যা ইতিহাসের সময়রেখার সাথে বৈশিষ্ট্যযুক্ত নয়, তবে তাঁর ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতি থেকে থেকে বঙ্গবন্ধুর কিছু নৈমিত্তিক বিষয় লক্ষ্য করা যায়। এ ধরণের কয়েকটি অনুষ্ঠানে যাওয়া আমার সৌভাগ্য ছিল এবং আমার প্রজন্মের বা প্রবীণদের কাছ থেকে আমি তাঁর সম্পর্কে শুনেছি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে, নেতৃত্ব দেয়ার যে কালজয়ী শিল্পের দুর্দান্ত পাঠ তা হলো নিজেকে জনগণের অংশ মনে করা। একজন নেতাকে অবশ্যই জনগণের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে এবং বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি সর্বদা অবিচ্ছিন্নভাবে এবং অবিস্মরণীয়ভাবে তাঁর জনগণের পক্ষে ছিলেন।