অব্যাহত ক্ষতির মুখে ইতোমধ্যে নগদ পুঁজি, জাল ও নৌকা হারিয়ে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে রয়েছে। আবার অনেকে মহাজনদের কাছ থেকে মোটা সুদে অর্থ নিয়ে এ পেশায় টিকে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
শুঁটকি পল্লী নির্ভর এক সময়ের পেশাদার জেলে মোখলেস হাওলাদার ও কাওছার জানান, অনেক আগে থেকে সুন্দরবনের মধ্যে এ শুঁটকি পল্লী তৈরী হয়। সন্দীপ ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় জেলেরা সুন্দরবনের এ চরে এসে শীতকালে অস্থায়ী বাসা তৈরি করে মৎস্য আহরণ করত।
পরে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালীর জেলেরা সুন্দরবন এলাকায় শুঁটকির জন্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ শুরু করেন বলে জানান তারা।
সুন্দরবনের মধ্যে জেলেরা ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির-হাঙ্গর, বনদস্যু-জলদস্যুর উৎপাত ও বনরক্ষীদের হয়রানীর মধ্যেও তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছেন।
সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে এ পল্লীর ৭ হাজার ৩২৫ জেলের কাছ থেকে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮১৯ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। আর চলতি ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৭ হাজার ৭৮৭ জন শুঁটকি পল্লির জেলের কাছ থেকে ২ কোটি ৭৩ লক্ষ ৯৮ হাজার ৪৮ টাকা সরকারিভাবে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। করোনার মধ্যেও যা বিগত বছরের তুলনায় বেড়ে ২৭ লক্ষ টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।
রামপাল গিলাতলা গ্রামের সমুদ্রগামী মৎস্যজীবী সমিতির সদস্য সৈয়দ শুকুর আলী জানান, দীঘ ৩৪ বছর ধরে তিনি এ পেশার সাথে যুক্ত। তার ৬টি জাল, ৩টি ট্রলার ও ২৮ জন কর্মচারী নিয়ে চলতি শুঁটকি মওসুমে সুন্দরবনে যেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, দ্রব্যমুল্যের ঊর্দ্ধগতির কারণে এ মওসুমে বহর নিয়ে সমুদ্রে যেতে হলে ২০ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। এ টাকার চাহিদা পূরণ করতে তাকে ব্র্যাক এনজিও থেকে ১০ লক্ষ টাকা, আশা এনজিও থেকে ৪ লক্ষ টাকা ও বাকী টাকা ৬ লক্ষ টাকা এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে মাত্র সাড়ে ৫ মাস মেয়াদে চড়াসুদে নিতে হয়েছে।
একই কথা বলেন রামপাল সদরের ফরহাদ শেখ। তিনিও জানান, প্রায় ২৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তাকে সাগরে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে নিজস্ব তহবিল থেকে সাড়ে ৯ লক্ষ টাকা ও বাকি টাকা চড়াসুদে এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে প্রতি লাখেয় ২৫ হাজার টাকা করে ঋণ নিতে হয়েছে। যা মাছ ধরার পর পরই পরিশোধ করা শুরু করতে হবে।
মৎস্যজীবী শ্রীফলতার শাহাজান শিকদার, সিকির ডাঙ্গার জুলফিকার গাজী, শ্রীফলতলার মো. জয়নাল শেখ, আনছার শিকদার, আক্কাছ আলী শেখ, ইউসুফ আলী শেখ, রামপাল সদরের জব্বার শেখসহ এ এলাকার জেলেদের কথায় আক্ষেপের সুর।
তারা জানান, র্দীঘ ৪০ বছর ধরে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ করে সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব দিলেও জেলেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেনি।
তারা আরও জানান, মৎস্য সমিতির মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায়, চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী বা ভাসমান হাসপাতাল না থাকায়, ঝড় ও জলোচ্ছাস থেকে রক্ষার জন্য সাইক্লোন শেল্টার ও সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জেলেদের।
সমুদ্রগামী জেলেদের সভাপতি শহিদ মল্লিক বলেন, ‘প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। সরকারিভাবে আমরা কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাই না।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ ধরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব সরকারকে দেই। কিন্তু আমরা সহজ শর্তে কোনো ঋণ পাই না।
তিনি সরকারের কাছে জেলে পল্লী এলকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেয়ার মতো ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানান।
এ ব্যাপারে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের ডিএফও মুহম্মদ বেলায়েত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ‘সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এ বনকে আমাদের বনবিভাগের চৌকস বাহিনী দিয়ে নজরদারীর আওতায় আনা হয়েছে। এরই অংশ হিসাবে গোটা সুন্দরবনে আধুনিক স্মার্ট প্যাট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বন বিভাগের এ কর্মকর্তার দাবি, জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালসহ অন্যান্য পেশাজীবীরা যাতে নির্বিঘ্নে বনজ সম্পদ আহরণ করতে পারে সেজন্য বনবিভাগের পক্ষ থেকে সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
তবে বনের সুরক্ষা নিশ্চিতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন বন বিভাগের কর্মকর্তা মুহম্মদ বেলায়েত হোসেন।