ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জোরপূর্বক, প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব এবং নানা প্রলোভন দেখিয়ে নারী ও শিশুদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটছে। কখনও আবার ধর্ষণের ভিডিওচিত্র মোবাইল ফোনে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে ধর্ষণকারীরা।
জেলার মোল্লাহাটে ৯ বছর বয়সী নাতনিকে প্রলোভন দেখিয়ে ও সদরে ফুফা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮ বছরের এক শিশু। ফকিরহাটে এক ভাইপো তার চাচীকে ধর্ষণ করেছে। টিনের চাল কেটে ঘরে ঢুকে এনজিও কর্মীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা যেমন ঘটেছে তেমনি পোশাক শ্রমিক কিশোরীকে ভ্যান থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে।
অক্টোবর মাসে বাগেরহাটে বিভিন্ন থানায় ১১ ধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে রামপালে গৃহবধূ ধর্ষণ মামলার আসামি ছাড়া অপর ১০ মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, অক্টোবর মাসের আগ পর্যন্ত চলতি বছরের কোনো মাসেই বাগেরহাটে ১১ ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত হওয়ার রেকর্ড নেই। অক্টোবরে দায়েরকৃত মামলাগুলোর মধ্যে মোংলায় সাত বছরের এক শিশু ধর্ষণের ঘটনার ১৫ দিন পর এবং মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ার সাত কর্মদিবসে (ঘটনা ৩ অক্টোবর এবং বিচার শেষ হয় ১৯ অক্টোবর) রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
রায়ে আদালত আসামি আব্দুল মান্নান সরদারকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জরিমান অনাদায়ে আরও এক বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মান্নান বর্তমানে কারাগারে বন্দী রয়েছেন।
বাগেরহাট পুলিশের তথ্য মতে, গত মাসে সদরে দুটি, ফকিরহাটে পাঁচটি এবং মোংলা, মোল্লাহাট, রামপাল ও চিতলমারী থানায় একটি করে ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এর আগে, জেলায় জানুয়ারিতে একটি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও জুনে আটটি, মে মাসে পাঁচটি, জুলাইতে ছয়টি, আগস্টে চারটি এবং সেপ্টেম্বর ছয়টি ধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়।
নির্যাতনের শিকার কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, জোরপূর্বক তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। হাত-পা ধরেও তারা রক্ষা পায়নি। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা।
ফকিরহাটে নারী এনজিও কর্মীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সৈয়দ বাবুল আকতার জানান, চার আসামির মধ্যে মো. মামুন শেখ (৩০) এবং মুসা ওরফে ইব্রাহিম নিকারীকে (২৯) আটক করা হয়েছে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অপর আসামিদের ধরার চেষ্টা চলছে।
পোশাক শ্রমিক ধর্ষণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. শফিকুর রহমান জানান, এর মধ্যে ধর্ষক ইউপি সদস্য শেখ মিজানুর রহমানসহ ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ওই ইউপি সদস্যসহ পাঁচজনকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
বাগেরহাটের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সীতা রানী দেবনাথ জানান, মামলা বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লাগার কারণে অপরাধীরা ফাঁকফোকর খোঁজে। দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে সাক্ষীরা অনেক কিছু ভুলে যায়।
অনেক সময় আসামিরা খালাস পেয়ে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মামলা দ্রুত বিচার হলে মানুষ ন্যায়বিচার পাবে।’
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর রনজিৎ কুমার মন্ডল বলেন, ‘ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক হতে হবে।’
নারী উন্নয়ন ফোরামের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক সম্বনয়কারি এবং বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন বলেন, ‘ধর্ষণ-নারী নির্যাতন বন্ধে পরিবারের সচেতনতা সব চেয়ে বেশি জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নারী-শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে যে সব কমিটি রয়েছে তার কার্যক্রম দৃশ্যমান করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে বড় পরিসরে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধে জনসচেতনতা করতে হবে। যারা ধর্ষণের মতো অপরাধের সাথে জড়িত তার পরিবার বা এই সমাজের বাইরের নয়।’
সমাজ সেবক নূর ইসলাম মোহন জানান, ‘সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়েছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় বলেন, ‘অক্টোবর মাসে দায়েরকৃত ধর্ষণ মামলার মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। অতীতের অনেক ঘটনায় কোনো এক প্রেক্ষাপটে অক্টোবর মাসে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ কারণেই মামলার সংখ্যা অনেক বেশি।’
তিনি জানান, বর্তমানে তদন্তাধীন ১০ মামলার মধ্যে ৯টি মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে এবং বিভিন্ন আলামত ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় সিআইডি পুলিশের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
‘বিচার প্রক্রিয়া তরান্বিত করার জন্য মামলা দ্রুত তদন্ত করে আদালতে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করা হবে,’ বলেন তিনি।