দিল্লিতে একটি চলন্ত বাসে পালাক্রমে ছয়জনের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২৩ বছর বয়সী এক মেডিকেল ছাত্রী, যা হতবাক করেছিল পুরো দেশকে। নৃশংস ও ভয়াবহ ওই ঘটনার সাত বছর পরও তেমন কিছুই বদলায়নি।
তবে অব্যাহতভাবে ভারতীয় নারীরা যৌন নিপীড়নের মুখোমুখি হতে থাকায় ধর্ষণবিরোধী আইন কঠোর করতে বাধ্য হয় দেশটির সরকার।
গত মাসেও ভারতের উত্তর প্রদেশে ‘উচ্চবর্ণের’ চার পুরুষের হাতে ধর্ষণের শিকার হন ১৯ বছর বয়সী ‘নিম্নবর্ণের’ এক তরুণী। দুই সপ্তাহ ধরে নিজের জীবনের সাথে যুদ্ধ করার পরে দিল্লির একটি হাসপাতালে মারা যান ওই তরুণী। এ ঘটনায় ভারতজুড়ে বিক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ার পরই গ্রেপ্তার করা হয় ধর্ষকদের।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরপরই তার সরকার নারীদের প্রতি সহিংসতা দূর করতে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিমালার প্রতিশ্রুতি দেন। এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে দেশটিতে প্রথমবারের মতো শিশু ধর্ষণকারীদের জন্য সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের আইন প্রবর্তন করে ভারত।
তবে পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি বলে মত বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের।
মনীষা রঞ্জন নামে দিল্লির একজন নারী অধিকার কর্মী বলেন, ‘ভারত এখনও বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা নিত্য ঘটনা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, কেবল গত বছরই প্রতিদিন গড়ে ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।’
যেখানে সমস্যা
ভারতের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণ বরাবরই আলোচনা নিষিদ্ধ বিষয় ছিল এবং এটি কখনও পাবলিক প্ল্যাটফর্মে আলোচনার আসল বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পায়নি। তবে ২০১২ সালে দিল্লিতে ভয়াবহ গণধর্ষণের ঘটনার পর নারীদের দুর্দশা ও ন্যায়বিচার সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়েছিল।
তৃপ্তি শর্মা নামে এক আইনজীবী বলেন, ‘ধর্ষণের পর বেঁচে যাওয়া মেয়ে বা নারী তার বিয়ে ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য সামাজিক সমস্যা ঘিরে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হন, তাতে তার ন্যায়বিচারের আশা প্রায়শই বাধাগ্রস্ত হয়। ধর্ষণে বেঁচে যাওয়া নারী যদি অবিবাহিত হয় তাহলে কে তাকে বিয়ে করবে? বিচারের পরিবর্তে এই প্রশ্নটিই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক।’
এই আইনজীবীর মতে, কোনো ধর্ষক যদি ভুক্তভোগীকে বিয়ে করার চুক্তির চেষ্টাও করে, তারপরও তাকে শাস্তি থেকে রেহাই দেয়া উচিত নয়।
‘বিলম্বিত রায় ও ঘৃণ্য এই অপরাধে সাজা পাওয়ার হার কম হওয়ায় ধর্ষণের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া অনেকে তাদের ওপর নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যেতে নিরুৎসাহিত হয়। ফলে অপরাধীরা শেষ পর্যন্ত আদালত থেকে জামিন পেয়ে যায়। পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতে ধর্ষণের প্রতি চারটি মামলার একটিতে সাজা হয়,’ বলেন তিনি।
এমনকি দিল্লির গণধর্ষণ মামলায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও আসামিদের ফাঁসি কার্যকর হতেও সাত বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল।
আরও পড়ুন: ভারতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ
তৃপ্তি শর্মা বলেন, ‘ধর্ষণকারীদের জন্য আইনগত বিভিন্ন প্রতিকার উপলব্ধ। এমনকি বিচারিক আদালত দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও ভারতে মামলা দীর্ঘায়িত করার জন্য যথেষ্ট উপায় রয়েছে। প্রথমে রাজ্য হাইকোর্ট এবং পরে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করার সুযোগ রয়েছে, যেখানে কেউ একাধিক পর্যালোচনা আবেদন দায়ের করতে পারে। সবশেষে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা বা ছাড়পত্রের আবেদন দাখিল করা যায়, যার মাধ্যমে এক দশক পর্যন্ত শাস্তি বিলম্ব করা যেতে পারে।’
ভারতের বিলম্বিত বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে দেশটির রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, শিশু ধর্ষণকারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার কোনো সুযোগ থাকা উচিত নয়।
গত বছর এক অনুষ্ঠানে ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ বলেন, ‘যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা আইনের আওতায় দোষী সাব্যস্ত ধর্ষণকারীদের ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ দেয়া উচিত নয়।’
বিস্ময়করভাবে, ভারতের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল তার পাঁচ বছরের মেয়াদের শেষ ২৮ মাসে রেকর্ড ৩০টি ক্ষমা বা ছাড়পত্রের আবেদন মঞ্জুর করেছেন, যার মধ্যে ২২টি ছিল শিশু ধর্ষণ ও হত্যার মতো নির্মম অপরাধের সাথে সম্পর্কিত। ভারতীয় সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে আসামি, এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদেরও ক্ষমা করা বা লঘু শাস্তি প্রদানের চরম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে।
সমাধান কি
নয়নতারা ঘোষ নামে অপর এক নারী অধিকার কর্মী বলেন, ‘ন্যায়বিচার বিলম্বিত করা মানে ন্যায়বিচার অস্বীকার করা হয়। দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গেলে, যৌন নির্যাতনকারীদের মধ্যে তা ভয় সৃষ্টি করবে যে তারা দেশের দীর্ঘ বিলম্বিত বিচারব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে সাজামুক্ত হতে পারবে না।’
তবে অনেক নারী অধিকার কর্মী বিশ্বাস করেন যে, নারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের মূল কারণ খুঁজে বের করার পরিবর্তে কঠোর শাস্তির বিধান এ ক্ষেত্রে শক্ত কোনো প্রতিরোধক নাও হতে পারে।
ভারতে নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ করার ছয় মাস আগে অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক অবিনাশ কুমার গত মার্চ মাসে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ভারতে প্রায়শই আইনপ্রণেতারা অপরাধ দমনে তাদের সংকল্পের উদাহরণস্বরূপ ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তবে আসলে যা প্রয়োজন তা হলো, লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা হ্রাস করার জন্য কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন সমাধান খুঁজে বের করা।’