এসবই সম্ভব হয়েছে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে ই- সেবার আওতায় নিয়ে আসার কারণে। ডিজিটাল দ্বীপ হিসেবে মহেশখালীকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন এই সেবা দেয়া হচ্ছে।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিয়া। আদিনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে সে। কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর এ শিক্ষার্থী প্রায়ই ঢাকার অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ নেয়। দূর শিক্ষণের মাধ্যমে সে নিজ বিদ্যালয়ে বসেই ইংরেজি, গণিত, বাংলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ নিচ্ছে।
জাগো ফাউন্ডেশনের জাগো ডিজিটাল স্কুলের শিক্ষক ফারিহা আহমদ ঢাকায় বসেই সরাসরি তাসনিয়াদের ইংরেজি পড়াচ্ছেন। তাসনিয়ার মতো বিদ্যালয়টির অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও খুশি দূর-শিক্ষণের মাধ্যমে ইংরেজি শিখতে পেরে।
তাসনিয়া বলেন, ‘ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আমরা ঢাকার ম্যাডাম থেকে পড়া শিখছি। এতে আমরা আনন্দ পাচ্ছি এবং নতুন অনেক কিছু শিখতে পারছি।’
দ্বীপের গোরকঘাটার আনোয়ারা বেগম তার ছয় বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু জটিল রোগ হওয়ায় তার মেয়েকে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শিব শেখর ভট্টাচার্য্য ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎমকের শরণাপন্ন হয়ে আনোয়ারা বেগমের মেয়েকে চর্ম রোগের ব্যবস্থাপত্র দিলেন। অর্থাৎ দ্বীপে থেকেই এখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন এখানকার মানুষ।
আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘মহেশখালীতে বসে বড় ডাক্তারের চিকিৎসা পেয়ে আমি খুব খুশি। এতে আমার সময় এবং টাকা দুটোই বেঁচে গেল।’
গত ২৭ জানুয়াররি মহেশখালী উপজেলার বিভিন্ন ই-সেবা কেন্দ্র, ই-কমার্স সেন্টার এবং ডিজিটাল স্কুলে সরেজমিনে গিয়ে এমনসব চিত্রই দেখা যায়। বর্তমান সরকার তথ্য প্রযুক্তির সেবা গ্রামের তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে পাইলট প্রকল্প হিসেবে মহেশখালী দ্বীপকেই বেছে নিয়ে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ই- সেবা প্রদান শুরু করেছে।
এদিকে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবার বদৌলতে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে মহেশখালীর তরুণদের জন্যও। দ্বীপের বাসিন্দা দিদারুল ইসলাম, মারুফা নাসরিন লোপা এবং রোমেনা আকতার। মূল ভুখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে শুধু পড়ালেখা নিয়েই বসে থাকেননি এই তরুণ-তরুণীরা। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছেন অনলাইন ব্যবসায়। নিজেদের গড়ে তুলছেন উদীয়মান উদ্যোক্তা হিসেবে।
এমনই ৯ জন তরুণ মিলে গড়ে তুলেছেন অনলাইনে বিষমুক্ত শুটকি বিকিকিনির ব্যবসা প্রতিষ্টান ‘ই-বিজনেস সেন্টার’। মাঠ পর্যায় থেকে বিষমুক্ত শুটকি মাছ সংগ্রহ করে অনলাইনে দেশের নানাপ্রান্তে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। তাদের উৎপাদিত পণ্য পাওয়া যাচ্ছে দেশের অন্যতম বৃহৎ অনলাইন প্রতিষ্ঠান দাড়াজেও। মহেশখালীতে বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও তাদের কাছ থেকে শুটকি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটি দেশের দ্রুততম ইন্টারনেট গতির মাধ্যমে মহেশখালীকে একটি বিচ্ছিন্ন উপদ্বীপ থেকে একটি উদীয়মান প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তর করতে সহায়তা করছে। এই প্রকল্পটি আইওএম বাংলাদেশ মিশনের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প।
আইওএম, কোরিয়া টেলিকম, বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল যৌথভাবে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটি দ্বীপের একটি পৌর এলাকা ও দুটি ইউনিয়ন এলাকার মানুষের মাঝে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল মহেশখালীকে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আইওএম-এর ট্রানজিশন অ্যান্ড রিকভারি ডিভিশনের (টিআরডি) প্রধান প্যাট্রিক শেরিগনন বলেন, ‘মহেশখালী দ্বীপকে এই প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল কারণ এটি বাংলাদেশের অন্যতম স্বল্পোন্নত অঞ্চল। এখানে নিরক্ষরতার হার বেশি এবং মাটির লবণাক্ততা কৃষি ফলনকে বাধাগ্রস্থ করে। স্থানীয় যুবসমাজ দ্বীপ থেকে স্থানান্তরিত হচ্ছে এবং এর ফলে এই দ্বীপের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে রয়েছে।’
এছাড়া, ডিজিটাল দ্বীপ প্রকল্পটির লক্ষ্য হল সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বিদ্যমান জনসুবিধাদির প্রসার ঘটিয়ে মহেশখালীর বাসিন্দাদের জন্য সুযোগ তৈরি করা।’
এই প্রকল্পের অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে মহেশখালীতে বিদ্যমান একটি টাওয়ার সংস্কার এবং গিগা মাইক্রোওয়েভ স্থাপন, যার ফলে মহেশখালীর বাসিন্দারা ১০০ এমবিপিএসেরও (মেগাবাইট পার সেকেণ্ড) বেশি গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছেন।
মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জামিরুল ইসলাম জানান, ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড একটি বহুমুখী প্রকল্প যা বাংলাদেশের অন্যতম বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে দেশের দ্রুততম গতির ইন্টারনেট মাধ্যমে বিশ্বের সাথে যুক্ত করেছে।’
তিনি আরও জানান, ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটির মাধ্যমে দ্বীপে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এর সুফলও দৃশ্যমান। টেলিমেডিসিন, দুর-শিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তি ও কমিউনিটি ক্লাবের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন সাধারণ মানষ।
এছাড়া দ্রুতগতির ইন্টারনেটের সহয়তায় উপজেলা প্রশাসন ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে ৮০ শতাংশ দাপ্তরিক কাজ করছে এবং এজন্য মহেশখালী উপজেলা প্রশাসন সারাদেশের সবগুলো উপজেলার মধ্যে ১৪তম অবস্থানে রয়েছে বলেও জানান জামিরুল ইসলাম।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা স্থানীয় জনগণকে উন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের পরিষেবাগুলো পেতে ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় শুটকি উৎপাদনকারিদের উৎপাদিত শুটকি বিক্রির জন্য ই-কমার্সের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড দ্বীপ’ উদ্যোগও বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি অংশ হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রকল্পটি ই-টিচিং এবং ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয় শিক্ষকদের সক্ষমতা উন্নত করছে। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পরে এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেয়া শিক্ষা-উপাদানগুলো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। কীটনাশক এবং সংরক্ষণকারী রাসায়নিক উপকরণগুলোর ব্যবহার কমিয়ে স্থানীয়দের জৈব কৃষি এবং অর্গানিক পদ্ধতিতে মাছ শুকানোতে উৎসাহিত করছে এই প্রকল্প। পাশপাশি ই-কমার্সের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে আয় বাড়ানো ও মধ্যস্বত্তভোগীদের দৌরাত্ম্য দূর করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
‘ডিজিটাল দ্বীপে’র সুবিধাভোগীরা জানান, আইওএম-এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫টি স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়েছে।
জাগো ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দূর-শিক্ষণ পরিষেবা দেয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় রাজধানী ঢাকার শিক্ষকরা মহেশখালী দ্বীপের শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ইংরেজি কোর্সে শিক্ষা দেন।
চারটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক এবং একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে মোবাইল স্বাস্থ্য পরিষেবাও পাওয়া যাচ্ছে। পরিষেবার মধ্যে রয়েছে- স্বয়ংক্রিয় স্বাস্থ্যগত রেকর্ড সিস্টেম, টেলিমেডিসিন পরামর্শ, মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ইত্যাদি।
স্থানীয় এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কম্পিউটার দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে আইওএমের গড়া ডিজিটাল সেন্টারে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে একটি কমিউনিটি ক্লাব এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে কম্পিউটার এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে বলে জানান তারা।
মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়া বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে মহেশখালীবাসী অনেক সুফল পাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঢাকার মতো শিক্ষা পাচ্ছে। কৃষকরাও সুফল পাচ্ছেন।
তবে মাত্র তিন বছরে মহেশখালীকে ডিজিটাল আইল্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল দ্বীপ হিসেবে শতভাগ সফলতা পেতে হলে এই প্রকল্প চলমান রাখতে হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর মহেশখালী দ্বীপে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড ফেস্ট’ আয়োজন করে আইওএম। সেখানে নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং ভিডিও-অনলাইনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে ‘ডিজিটাল দ্বীপ’- কে তুলে ধরেন স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীরা।