অবৈধ পলিথিন ব্যাগ বন্ধে সরকারের উদ্যোগের তেমন কোনো সফলতা চোখে পড়ছে না। সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যের বিকল্প শপিং ব্যাগ না থাকায় এ উদ্যোগ ব্যর্থ হতে চলেছে।
গত ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন ব্যাগের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞার এক মাস পেরিয়ে গেলেও বিভিন্ন কাঁচাবাজার, মুদি দোকান ও বিক্রেতাদের ওপর পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযানের দৃশ্যমান কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।
পরিবেশকর্মী, সাধারণ মানুষ ও দোকান মালিকরা বলছেন, পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন বন্ধ এবং পলিথিনের কাঁচামাল আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা উচিত সরকারের। পাশাপাশি উপযুক্ত ও সাশ্রয়ী বিকল্প উদ্ভাবনের দিকে মনোনিবেশ করা দরকার।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) নির্বাহী সভাপতি ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক পদক্ষেপ। কিন্তু যতই চাপ প্রয়োগ করা হোক না কেন, জনগণকে কার্যকর বিকল্প না দিয়ে এটি বন্ধ করা কঠিন হবে।’
পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি সরকারকে পাটের ব্যাগকে সস্তা ও সহজলভ্য করার পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে সরকারকে পাটের ব্যাগকে প্রতিযোগিতামূলক করতে ভর্তুকি দিতে হবে, কারণ এগুলো প্রকৃতিবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব।
২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সরকারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা সম্পর্কে এই পরিবেশকর্মী বলেন, তৎকালীন সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করার পর কার্যকর বিকল্প দিতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে তা সফল হয়নি।
তিনি বলেন, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিবর্তন করা সহজ কাজ নয়।
তিনি বলেন, 'আমাদের জনগণকে পলিথিন ব্যাগের কার্যকর বিকল্প দিতে হবে; তা না হলে এবারও এ উদ্যোগ পুরোপুরি সফল হবে না।’
পরিবেশকর্মী অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ২০০২ সালে যখন প্রথম পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়, তখন মানুষ শাস্তির ভয়ে কিছু দিন তা ব্যবহার থেকে বিরত ছিল। তবে উপযুক্ত বিকল্প ব্যাগ না পাওয়ায় আবারও পলিথিন ব্যবহার শুরু করেন তারা।
তিনি বলেন, 'এবার শুধু পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার দিকেই নজর দেওয়া হচ্ছে। বিকল্প উৎপাদনের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না।’
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মজুমদার বলেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় এক হাজার ছোট কারখানায় পলিথিন ব্যাগ তৈরি হয়। তাই কারখানা বন্ধ করে কাঁচামাল আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির দিকে সরকারকে আরও নজর দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক পলিউশন স্টাডিজের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মজুমদার বলেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনসচেতনতা তৈরি, পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন বন্ধ করা এবং সস্তায় বিকল্প ব্যাগ উৎপাদন একযোগে করতে হবে।
রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা মঈন উদ্দিন বুধবার পশ্চিম শেওড়াপাড়ার কাঁচাবাজার থেকে ফিরছিলেন। এ সময় চারটি পলিথিন ব্যাগের করে সবজি ও মুদি সামগ্রী বহন করতে দেখা যায় তাকে।
অবৈধ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সস্তায় বিকল্প কোনো ব্যাগ পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, ‘সরকার যদি সত্যিই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে চায়, তাহলে প্রথমে আমাদের বিকল্প ব্যাগ সরবরাহ করা উচিত এবং পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন বন্ধ করা উচিত।’
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আনিসুল ইসলাম। মৌচাকে সবজি কিনলে বিক্রেতারা তিনটি পলিথিন ব্যাগের করে তা দেন। বিকল্পের অভাবকেই দায়ী করেছেন তিনিও।
শেওড়াপাড়ার আনন্দবাজারের নুরুল হক নামে এক সবজি বিক্রেতা বলেন, ক্রেতাদের পলিথিন ব্যাগ সরবরাহ করলে তার বিক্রি অনেক কমে যাবে।
নুরুল বলেন, ‘সরকার যদি পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করতে পারত তাহলে আমার আয় বাড়ত। প্রতিদিন পলিথিন ব্যাগ কিনতে আমার ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা খরচ করতে হতো না। দোকানের জন্য প্রতিদিন ১৭০-২০০ পলিথিন ব্যাগ লাগে।’
পশ্চিম শেওড়াপাড়ার মুদি দোকানি শফিকুল ইসলামও বিকল্প ব্যাগ তৈরি না করে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার জন্য সরকারের সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, ‘পলিথিন ব্যাগ না দিলে ক্রেতারা আমার দোকান থেকে কিনবে না।
তিনি বলেন, তার প্রতিদিনের বিক্রির জন্য প্রায় ২৫০-৩০০ পলিথিন ব্যাগ লাগে।
এই মুদি দোকানে অবশ্য বাজার থেকে পলিথিন ব্যাগ বর্জনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। তাদের উৎপাদন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
শফিকুল বলেন, 'ক্রেতাদের অভ্যাস আগে বদলাতে হবে। উপযুক্ত বিকল্প ব্যাগ পাওয়া গেলে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করা যেতে পারে।’
একক ব্যবহারের পণ্য যেমন ব্যাগ, বোতল, স্ট্র ও প্যাকেজিং উপকরণের অতিরিক্ত ব্যবহারের অন্যতম প্রধান কারণ হলো এগুলো পুনঃপ্রক্রিয়া না করা, যার ফলে এগুলো শেষ পর্যন্ত ভাগাড়, জলাশয় ও প্রাকৃতিক পরিবেশে চলে যায়।
আরও পড়ুন: পলিথিনবিরোধী অভিযানে ১৯ লাখ টাকা জরিমানা: মনিটরিং কমিটির সভাপতি
প্লাস্টিক পণ্যের অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদন
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার পেছনে প্লাস্টিক শিল্প সবচেয়ে বেশি দায়ী। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্লাস্টিক প্রস্তুতকারক কাজ করছে। এসব স্থানে প্রায় ১২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে (বিডা, ২০২১)।
শহরাঞ্চলে বাংলাদেশের বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০০৫ সালে ছিল ৩ কেজি। সেখান থেকে ২০২০ সালে তিনগুণ বেড়ে ৯ কেজিতে দাঁড়িয়েছে।
২০০৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এলডিপিই প্যাকেজিং উপকরণের (প্লাস্টিক ব্যাগ ইত্যাদি) ব্যবহার পাঁচগুণ বেড়েছে। ২০২০ সালে ব্যবহৃত ৯ লাখ ৭৭ হাজার টন প্লাস্টিকের মধ্যে মাত্র ৩১ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে।
প্লাস্টিক দূষণের শীর্ষ ১০টি হটস্পট:
• চীন: প্রতি বছর ২৮ লাখ টন
• পাকিস্তান: প্রতি বছর ২৬ লাখ টন
• বাংলাদেশ: প্রতি বছর ১৭ লাখ টন
• রাশিয়া: প্রতি বছর ১৭ লাখ টন
• ব্রাজিল: প্রতি বছর ১৪ লাখ টন
• থাইল্যান্ড: প্রতি বছর ১০ লাখ টন
• ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো: প্রতি বছর ১০ লাখ টন।
আরও পড়ুন: যৌথবাহিনীর অভিযানে ২৪৬০ কেজি পলিথিন জব্দ, ৩ কারখানা সিলগালা