চলতি বছরের ১৮ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শাবির এই ল্যাব উদ্বোধন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, উদ্বোধন পরবর্তী এই ল্যাবের কার্যক্রমে কোনো ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়নি। এছাড়া চালু হওয়ার পর ল্যাবের কোনো কার্যক্রম একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।
এর আগে বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য চলতি বছরের ৯ এপ্রিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় করোনাভাইরাস সনাক্তকরণের জন্য পিসিআর ল্যাব চালুর অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে শিক্ষাভবন ‘ই’ এর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের ২২৫ নম্বর কক্ষে এ ল্যাব চালু করা হয়।
সরেজমিনে জানা যায়, ল্যাব চালু হওয়ার প্রথম দিকে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা থেকে প্রতিদিন ২০০ এর মতো নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হতো। বর্তমানে সিলেট বিভাগের চার জেলা হতে গড়ে ৪০০ এর কাছাকাছি নমুনা জমা পড়ে শাবির এই করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবে। আগের চাইতে নমুনা বৃদ্ধির সাথে সাথে টেস্টের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। যার ফলে ল্যাবে কোনো ধরণের নমুনা জট সৃষ্টি হয়নি এখন পর্যন্ত। ফলাফল বিশ্লেষণের পরপরই টেস্ট রিপোর্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহে দ্রুতই প্রেরণ করা হয়। এছাড়াও শাবির এই ল্যাব থেকে রোগীদের ফলাফল পেতে কোনো ধরণের ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। শাবির এই করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবে একদিনে সর্বোচ্চ ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শাবির করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবে মোট ১৭ হাজার ৩৬০ জন সন্দেহজনক ব্যক্তির কোভিড-১৯ সংক্রমণের পরীক্ষা করা হয়েছে এবং ৩ হাজার ৬৬০ জন রোগীকে কোভিড-১৯ পজিটিভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
শাবিপ্রবির করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবের তত্ত্বাবধান করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জিনোম ও জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল ডিএনএ/আরএনএ নিয়ে গবেষণার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় নমুনা পরীক্ষায় স্বচ্ছতা ও নির্ভরতার বিষয়টি থাকছে শতভাগ।
বর্তমানে এই বিভাগের ৩০ জনের একটি টিম প্রতিদিন কাজ করছে এবং এই টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন টিম লিডার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক প্রধান।
ল্যাবে করোনা শনাক্তকরণে যারা কাজ করছেন তাদের থাকা, খাওয়া, পরিবহনসহ স্বাস্থ্যগত সব নিরাপত্তার বিষয়গুলোর দেখভাল করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শাবিপ্রবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা কেবল নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব নয়, দেশের অন্যান্য করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবগুলোতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়াও সিলেটে স্থাপিত অন্যান্য ল্যাবগুলোতে পরিদর্শক হিসেবে কাজ করছেন এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে বিভাগের পিএইচডি গবেষক নাজমুল হাসান নাঈম বলেন, ‘দেশে কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই আমাদের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দক্ষ শিক্ষার্থীরা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশন এবং সিএমএইচ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন কোভিড-১৯ ডিটেকশন ল্যাবে কাজ করে আসছে। তাছাড়া আমাদের বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকরা স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন যারা বর্তমানে বিভাগে এবং সীমান্তিক, ল্যাবএইডসহ বিভিন্ন বেসরকারি ল্যাবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে।’
করোনা পরবর্তী শাবির এই পিসিআর ল্যাবটি অন্যান্য ভাইরাসের সংক্রমণ নির্ণয়, গবেষণাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যাবে।
এ বিষয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক জিএম নূরনবী আজাদ জুয়েল বলেন, ‘আমাদের আরটি-পিসিআর ল্যাবটি বায়োসেফটি লেভেল ২ (বিএসএল-২) মানের এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে করোনা শনাক্তকরণের কাজে ব্যবহৃত হলেও করোনা পরবর্তীকালে এই ল্যাবে অন্যান্য ক্ষতিকারক ও সংক্রামক রোগজীবাণু এবং ভাইরাস যেমন আমাদের দেশের মৌসুমী রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস শনাক্তকরণ এবং এগুলো নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করা সম্ভব।’
এছাড়াও অন্যান্য গবেষণার পাশাপাশি এই ল্যাবে বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সাধারণ গবেষণা ও ল্যাব কার্যক্রম পরিচালনা এবং হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা যাবে।
ইতোমধ্যে করোনা শনাক্তের তথ্যের উপর নির্ভর করে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে জানালেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. হাম্মাদুল হক।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে গবেষণার রূপরেখা সাজিয়েছি এবং আমাদের গবেষণার কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু অর্থ বরাদ্দ করেছেন। আমরা উপাচার্য স্যার, কোষাধ্যক্ষ স্যারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।’
‘গবেষণার জন্য ল্যাবে আরও কিছু সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদি ক্রয় করা হবে যা দিয়ে করোনা নিয়ে উচ্চমানের গবেষণা চালানো হবে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ দেশের মানুষের কল্যাণে এ সংশ্লিষ্ট গবেষণা করতে বদ্ধপরিকর,’ যোগ করেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক প্রধান ইউএনবিকে বলেন, ‘শাবির এই ল্যাবে করোনা শনাক্তকরণে কেবল জীবপ্রযুক্তিবিদরাই কাজ করছেন। বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশমাতৃকার টানে বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এই ল্যাবে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে। আমাদের ল্যাবটিতে ডব্লিওএইচও এবং সিডিসি এর গাইড লাইন মেনে বায়োসেইফটি লেভেল-২ (প্লাস) মানের ল্যাবটি তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের উচ্চতর গবেষণার জন্য এরকম সুন্দর একটি ল্যাব স্থাপন করে দেয়ার জন্য।’
দেশবাসীর প্রত্যাশার কথা জানিয়ে শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এ বৈশ্বিক দুর্যোগকালীন সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অত্যাধুনিক এ ল্যাবটি প্রতিষ্ঠা করেছি। শাবিপ্রবি’র উপর দেশবাসীর পাশাপাশি সিলেটের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানবিক দিক বিবেচনায় এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা রাত-দিন করোনা ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং আমাদের ল্যাবটি সকলের আস্থা অর্জন করেছে।’
‘আমরা জেনম সিকোয়েন্সংয়ের জন্য আরও একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠায় কাজ করছি। আশা করি অচিরেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক অনন্য উচ্চতায় জায়গা করে নেবে,’ যোগ করেন উপাচার্য।