দৌলতদিয়ার জয়পুর, মানিকগঞ্জের মোল্যার চর, কানাইদা, চর লতিফপুর, পাবনার নগরবাড়ি, নাকালিয়া ও মোহনগঞ্জ এলাকায় ডুবোচরের কারণে পণ্যবাহী কার্গো সরাসরি বাঘাবাড়ি পৌঁছতে পারছে না।
বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পাথর, কয়লা, গম, সারসহ বিভিন্ন পণ্য জাহাজে করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে আসে। সেখান থেকে কার্গো জাহাজ বোঝাই করে এসব পণ্য বাঘাবাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা করে দৌলতদিয়ায় এসে বিরতি দিচ্ছে। তবে নাব্যতা সংকটের কারণে কিছু পণ্য এখান থেকে খালাসের পর চলাচলের উপযোগী করে তবে বাঘাবাড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং এক সপ্তাহ ধরে পণ্যবাহী জাহাজগুলো আটকে আছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা কার্যালয় জানায়, চট্টগ্রাম থেকে দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত নৌপথের দূরত্ব ৩৭০ কিলোমিটার। দৌলতদিয়া থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত নৌপথের প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব। এর মধ্যে দৌলতদিয়া থেকে পাবনার নগরবাড়ির দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। নগরবাড়ি থেকে বাঘাবাড়ির দূরত্ব আরও ২০ কিলোমিটার। সবমিলে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি বাঘাবাড়ি পর্যন্ত নৌপথের প্রায় ৪২০ কিলোমিটার দূরত্ব। এই নৌপথ দিয়ে চট্টগ্রাম বা মোংলা থেকে আসা এসব কাঁচামাল বা জরুরি পণ্য বাঘাবাড়ি পৌঁছতে সময় লাগে ৪-৫ দিন। নৌপথের ৬-৭টি স্থানে ডুবোচর জেগে ওঠায় সরাসরি যেতে না পেরে তিন দিনে দৌলতদিয়ায় পৌঁছে পণ্য খালাসের জন্য আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যে কারণে এসব পণ্য বাঘাবাড়ি পৌঁছতে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে।
গত ২১ নভেম্বর সরেজমিনে দেখা গেছে, দৌলতদিয়ার ৬ নম্বর ফেরি ঘাটের অদূরে বাহির চরে ৩৫টির মতো কার্গো-জাহাজ নোঙ্গর করে রয়েছে। জাহাজ মাস্টার, ড্রাইভার, সুকানিসহ অন্যান্য স্টাফ ঘোরাফেরা করছে। এসব কার্গোতে পাথর, কয়লা সার ও গম রয়েছে। ১৫০ জনের মতো শ্রমিক জাহাজ থেকে এসব পণ্য বলগেটে খালাসের কাজ করছে।
পাথর ও কয়লা দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে আমদানি করা। পাথর ও কয়লা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাবনার নগরবাড়ি যাবে। সেখান থেকে ঈশ্বরদী হয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাবে। সার ও গমও বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়।
এ সময় এমভি নাফিজ-১, এমভি গোলাপ-৪, এমভি সোলার জেট, এমভি সাথী ভাই-২, এমভি সামিন-সোহেল-১, এমভি সোবহান-১, এমভি সোনিয়া-৭, এমভি প্রিন্স মেম, এমভি সনজিদ, এমভি সাদি বেঙ্গল, এমভি গোল্ডেন রোজ, এমভি কুইন অব ফিরোজা-২, এমভি মশিউর সামিয়া, এমভি নুসরাত ইসলাম, এমভি আরাফাত ময়দান, এমভি সাহারাস্তি-২, এমভি আনিকা সামিহা, এমভি ওয়াফি, এমভি খিজির তরী, এমভি প্রিন্স অব সোবহান, এমভি নাফিজ-২, এমভি আসাদ-১, এমভি আনিশা, এমভি গ্লোবালিজ-২, এমভি সামিরা গোলাপ, এমভি ওয়ারিশা আহনা, এমভি সুলতানা মান্নানসহ ৩৫টির মতো কার্গো নদীতে ভাসতে দেখা যায়। এক সপ্তাহ ধরে অধিকাংশ জাহাজ এখানেই অপেক্ষা করছে।
জাহাজ এমভি নাফিজ-১ এর সুকানি (চালক) রোকন উজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ১ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন গম বোঝাই করে এক সপ্তাহ আগে বাঘাবাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা করে গত সোমবার দৌলতদিয়ায় এসে পৌঁছান। এখানে অন্তত ৪০০ টন গম খালাসের পর ড্রাফট কমে আসলে বাঘাবাড়ির রওয়ানা করবেন। তার আগে আরও অনেক জাহাজ এসে এখানে অবস্থান করছে। নাব্যতা দূর করতে দ্রুত খনন কাজ শুরু না করলে আরও খারাপ পরিণত হবে।
এমভি প্রিন্সেস মিমের মাস্টার আব্দুল হান্নান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১ হাজার ১০০ টন পাথর নিয়ে পাবনার নগরবাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা করে গত ১৫ নভেম্বর দৌলতদিয়ায় এসে আটকে আছি। এখান থেকে কমপক্ষে ১৫০ টন পাথর নামানোর পর যেতে পারবো। ২২ নভেম্বর (শুক্রবার) দুপুরে পাথর খালাসের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এখনো আরও দুইদিন থাকতে হবে। জাহাজের ১৩ জন স্টাফদের পেছনে প্রতিদিন প্রায় ১২’শ টাকা খরচ হয়। এসব টাকা ব্যক্তিগতভাবে খরচ হয়। অথচ সরাসরি জাহাজ যেতে পারলে কোম্পানি আরও বেশি পণ্য ট্রিপ দিতে পারত।
পণ্য খালাসের জন্য দৌলতদিয়া ঘাটে শ্রমিক জোগানের দায়িত্বে থাকা মেসার্স আরিফ ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড কমিশন এজেন্টের ব্যবস্থাপক মনির উদ্দিন সরদার বলেন, ৩টি গ্রুপে ১৫০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করছে। অধিকাংশ শ্রমিক নগরবাড়ি থেকে এসেছে। নাব্যতা স্বল্পতার কারণে এক সপ্তাহ ধরে এখানে জাহাজ ভিড়ছে। শ্রমিক সংকট থাকায় ১৯ নভেম্বর থেকে পণ্য খালাস শুরু হয়। প্রতিদিন গড়ে ৬-৭ হাজার বস্তা খালাস করতে পারে। আর কিছু দিন পর জাহাজ বেড়ে গেলে শ্রমিক স্বল্পতার কারণে সমস্যা বেড়ে যাবে। প্রতি বস্তা মাল থেকে ট্রান্সপোর্টকে ৩ টাকা করে দেয়। এর মধ্যে শ্রমিকদের দিতে হয় বস্তা প্রতি ২ টাকা ৬০ পয়সা।
বাংলদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা কার্যালয়ের যুগ্ম-পরিচালক (নৌসপ) আব্দুর রহিম বলেন, অক্টোবর মাসের শেষের দিক থেকে নাব্যতা দেখা দেয়। দৌলতদিয়া থেকে বাঘাবাড়ির ৫০ কিলোমিটার নৌপথের ৬-৭টি স্থানে ডুবোচর ওঠায় সরাসরি জাহাজ যেতে পারছে না।
তিনি বলেন, বর্তমানে পানির গভীরতা রয়েছে ৭-৮ ফুট। পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য প্রয়োজন ১১ ফুট। নাব্যতা দূর করতে ইতোমধ্যে বিআইডব্লিউটিয়ের নিজস্ব দুটি ড্রেজার (খননযন্ত্র) আনা হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে খনন করে ২ ফুট করে গভীরতা বাড়লে ও কিছু পণ্য খালাসের পর ৯ ফুট করে পানি পেলে জাহাজ যেতে পারবে।
এছাড়া আগামী বছরের মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ সমস্যা থাকতে পারে বলে জানান তিনি।