নাসরিন এখন একটি কেঁচো কম্পোস্ট (ভার্মি কম্পোস্ট) সার কারখানার মালিক। কেঁচো কম্পোস্টের মাধ্যমে তৈরি করছেন জৈব সার। এই সারের চাহিদা ক্রমশই বাড়ছে। তবে বিনিয়োগ বাড়াতে না পাড়ায় উৎপাদন বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
নাসরিনের ভাষ্য, পাঁচ লাখ টাকার বিনিয়োগ করতে পারলে তিনি উৎপাদন বাড়াতে পারতেন কয়েকগুণ। এতে কৃষকদের চাহিদা মতো ভার্মি কম্পোস্ট জোগান দিতে পারতেন তিনি। আর চাহিদা বাড়ার কারণ হলো জৈব সার ব্যবহারে জমির ঊর্বরশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি ফলন বৃদ্ধি হয় দ্বিগুণ।
আরও পড়ুন: অসময়ে তরমুজ চাষে ভাগ্যবদল রূপসার ২০ চাষির
নাসরিন সুলতানার কারখানায় প্রতি নান্দায় (মাটিরপাত্র) প্রতি মাসে তৈরি হচ্ছে ১৯৫-২০০ কেজি জৈব সার। নাসরিনের কারখানায় নান্দা রয়েছে ১৩০টি। নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগানোর পাশাপাশি সংসারেও আর্থিক যোগান দেন তিনি।
কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি ও বিক্রি করে অভাবী পিতামাতার সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। নাসরিন প্রমাণ করে দিয়েছেন মেয়েরা পিতা-মাতার সংসারের বোঝা নন। তারাও নিজের ইচ্ছাশক্তি ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে হতে পারেন সফল উদ্যোক্তা।
চার বছর আগে ১০০ গ্রাম কেঁচো দিয়ে দুটি নান্দায় দুই ঝুড়ি গোবর সার দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল নাসরিনের কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরির প্রাথমিক ধাপ। প্রথমদিকে সহপাঠী, প্রতিবেশীরা উপহাস করলেও এখন তারা রীতিমতো উৎসাহের পাশাপাশি অনেকেই আবার নিজেই এই কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরিতে ঝুঁকেছেন।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে হাঁস পালনে বেকার যুবকদের ভাগ্য বদল
২০১৬ সালের প্রথম দিকে ওই এলাকার ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আইয়ুব হোসেন দেড়শ টাকা দিয়ে ১০০ গ্রাম কেঁচো কিনে দিয়েছিলেন। দুটি নান্দা (মাটিরপাত্র) কিনে সেই কেঁচো দিয়ে দুই ঝুড়ি গোবরের মাধ্যমে জৈব সার তৈরি শুরু করেছিলেন নাসরিন।
তা থেকে প্রথম বছরে যে সার তৈরি হয়েছিল সেটা তার পিতা লুৎফর রহমান জমিতে ব্যবহার করেছিলেন। ১০০ গ্রাম কেঁচো থেকে বর্তমান নাসরিনের ১৩০টি নান্দায় কেঁচো রয়েছে ৩৫-৪০কেজি। এক কেজি কেঁচোর দাম দেড় হাজার টাকা।
নাসরিন এ বছর কেঁচো কম্পোস্ট (ভার্মি কম্পোস্ট) সার তৈরির জন্য একটি চালা (সেড) তৈরি করেছেন।
আরও পড়ুন: সরিষা চাষে ভাগ্য ফিরছে যশোরের কৃষকের
তিনি জানান, তার ১৩০টি নান্দার জন্য চালা তৈরি, মাঁচা, বেড়া ও ছাউনী ঘেরা দিয়ে মোট খরচ হয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। তাদের ৮টি গরু আছে। ফলে তার গোবর কেনার প্রয়োজন পড়ে না।
প্রতিটি নান্দায় ২০০ গ্রাম কেঁচো আর একঝুড়ি গোবর দিলে তা থেকে ২০-২৫ দিনের মাথায় ১৯৫ থেকে ২০০ কেজি জৈব সার পাওয়া যায়। এক কেজি জৈব সারের দাম ১০-১২ টাকা। পাশাপাশি প্রতি নান্দা থেকে তিনমাস অন্তর দুই কেজি থেকে তিন কেজি করে কেঁচো বিক্রি করা যায়।
নাসরিনের কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরিতে এলাকাতে এই সারের কদর বেড়েছে। এলাকার চাষীরা অগ্রিম বায়না দিয়ে যাচ্ছে এই সার কিনতে। নিরাপদ (বিষমুক্ত) সবজী উৎপাদনে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত উপজেলার বোধখানা গ্রামের আলী হোসেনসহ এলাকার প্রায় ২ হাজার চাষী ৬০-৭০ ভাগ জমিতে কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহার করছেন।
আরও পড়ুন: বেগুন চাষে ভাগ্য বদল ফরিদপুরের চাষিদের
এই সার সকল ফসলে ব্যবহার উপযোগী। নাসরিনের এই কারখানা থেকে প্রতিমাসে তার আয় ১২-১৫ হাজার টাকা। ভার্মি কম্পোস্ট সারের পাশাপাশি নাসরিন সুলতানা নিজ বাড়ির ছাদে গড়ে তুলেছেন বিষমুক্ত ছাদ কৃষিবাগান।
নাসরিন সুলতানা যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়নের বারবাকপুর গ্রামের লুৎফর রহমানের মেয়ে। তার মায়ের নাম শিউলী বেগম।
দুই ভাই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। নাসরিন সুলতানা উপজেলার দিগদানা খোশালনগর দাখিল মাদরাসা কারিগরি এবং কৃষি কলেজে ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার শিক্ষা কার্যক্রমের উপর ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করার পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঝিকরগাছা মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স (সম্মান) সম্পন্ন করেছেন।
আরও পড়ুন: কয়লা কুড়িয়ে ভাগ্য বদল!
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিরক কুমার সরকার জানান, জৈব সার ব্যবহারে জমির ঊর্বরাশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি ফলন বৃদ্ধি হয় দ্বিগুণ। কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি ও বিক্রি করে অভাবী পিতামাতার সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন নাসরিন। তার দেখা দেখি আরও অনেক নারী এগিয়ে আসছেন।