চলুন জেনে নেয়া যাক বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা বান্দরবানের আকর্ষণীয় ৫টি পর্যটন কেন্দ্র সম্পর্কে।
১. বগা লেক:
বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক লেক বলা হয়ে থাকে বগা লেককে। এই লেকটি বাগাকাইন বা বাগা লেকেইস নামেও পরিচিত। বান্দরবানের রুমা সদর উপজেলা থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বগা লেকের অবস্থান। প্রায় ১৫ একর আয়তনের এই লেকটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। বগা লেকের আশপাশে আদিবাসী বাউম ও খুমি সম্প্রদায়ের বসবাস।
বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, দুই হাজার বছর আগে শক্তিশালী এক ভূমিকম্প থেকে বগা লেক সৃষ্টি হয়েছিল। এছাড়া বগা লেকের সৃষ্টির পেছনে নানা ধরনের অতিপ্রাকৃতিক কল্পকাহিনীও শোনা যায়।
যেভাবে বগা লেকে যেতে পারেন:
বান্দরবান পৌঁছানোর পর ‘চাঁন্দের গাড়ি’ ভাড়া করে যেতে হবে রুমা উপজেলায়। রুমা থেকে বগা লেক পৌঁছাতে চাঁন্দের গাড়িতে আপনাকে আরও একটি সফর করতে হবে। আর বাসে যেতে চাইলে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৩০০ টাকা।
যাওয়ার পথে আপনাকে স্থানীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু প্রাথমিক তথ্য (নাম, ঠিকানা ইত্যাদি) নিবন্ধিত করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, বিকাল ৪টার পর রুমা থেকে বগা লেকের দিকে যাওয়ার অনুমতি নেই।
২. তাজিংডং পাহাড়:
তাজিংডং (বিজয় নামেও পরিচিত) বাংলাদেশের একটি পর্বতশৃঙ্গ। সরকারিভাবে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার সাইচল পর্বতসারিতে অবস্থিত। সরকারি হিসাবে তাজিংডং পর্বতের উচ্চতা ১,২৮০ মিটার (৪১৯৮.৪ ফুট)। পূর্বে কেওক্রাডংকে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মনে করা হলেও, আধুনিক গবেষণায় এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি গবেষণায় সাকা হাফং পর্বতকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দাবি করা হয়, তবে এটি এখনও সরকার স্বীকৃত নয়। স্থানীয় উপজাতীয়দের ভাষায় ‘তাজিং’ শব্দের অর্থ বড় আর ‘ডং’ শব্দের অর্থ পাহাড়। অর্থাৎ তাজিংডং এর পুরো নাম দাাঁড়ায় বড় পাহাড়।
যেভাবে যেতে পারেন তাজিংডং পাহাড়ে:
প্রথমে আপনাকে বান্দরবান আসতে হবে। রাজধানী ঢাকা থেকে বিভিন্নভাবে বান্দরবান আসা যায়। বাসযোগে সরাসরি আসা যায় বা তবে ভেঙে আসলে বাস, ট্রেন বা পছন্দসই যেকোনো মাধ্যম বেছে নিতে পারেন। বান্দরবান থেকে বাসে করে রুমা সদর উপজেলা যাওয়া যায়। প্রতি এক ঘণ্টা পরপর একটি করে বাস বান্দরবান থেকে রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এছাড়া চাঁন্দের গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারবেন রুমায়। সেখান থেকে আপনাকে যেতে হবে বগা লেক। আর বগা লেক থেকে ট্রেকিং করে তাজিংডং পৌঁছাতে পারবেন।
৩. বান্দরবান স্বর্ণমন্দির:
বর্তমানে বান্দরবান জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে স্বর্ণমন্দির। বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে বালাঘাট এলাকায় অবস্থিত এই স্বর্ণমন্দির। এটি মহাসুখ মন্দির বা বৌদ্ধ ধাতু জাদি নামেও বহুল পরিচিত। এর নাম স্বর্ণ মন্দির হলেও, এখানে স্বর্ণ দিয়ে তৈরি কোনো স্থাপনা নেই। মূলত মন্দিরে সোনালী রঙের আধিক্যের কারণেই এটি স্বর্ণ মন্দির নামে পরিচিত। এই মন্দিরটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র এক তীর্থস্থান।
দর্শনার্থী প্রবেশে কিছুদিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বর্তমানে স্বর্ণমন্দিরটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
যেভাবে যাবেন:
বান্দরবান শহর থেকে কাছে হওয়ায় রিকশা বা অটোরিকশা করেই যেতে পারবেন স্বর্ণমন্দিরে। প্রবেশমূল্য পড়বে জনপ্রতি মাত্র ১০ টাকা। বান্দরবান স্বর্ণমন্দিরটি পর্যটকদের জন্য বিকাল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
৪. নাফাখুম জলপ্রপাত:
বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে এই জলপ্রপাতটি অবস্থিত। রেমাক্রি মূলত মারমা একটি অধ্যুষিত এলাকা। বান্দরবান শহর থেকে ৭৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত থানচি। সাঙ্গু নদীর পাড়ে অবস্থিত থানচি বাজার। এই সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রীর দিকে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে হয় নৌকা বেঁয়ে। কারণ নদীটি রেমাক্রী হতে থানচির দিকে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে এসেছে এবং এজন্য এখানে অনেক স্রোত থাকে। নদীর কিছুদূর পর পর ১-২ ফুট এমনকি কোথাও কোথাও ৪/৫ ফুট পর্যন্ত ঢালু হয়ে নিচে নেমেছে। নদীর দুপাশে রয়েছে সবুজে মোড়ানো উঁচু উঁচু পাহাড়। কোনো কোনো পাহাড় এতই উঁচু যে তার চূড়া ঢেকে থাকে মেঘের আস্তরে। সবুজে ঘেরা সে পাহাড়ে মাঝে মাঝে দু একটি উপজাতী বসতঘর দেখা যায়। প্রকৃতির এমন অপরূপ সৌন্দর্য যে কারও নজর কাড়বে নিঃসন্দেহে। রেমাক্রী থেকে তিন ঘণ্টার হাঁটা পথ দূরত্বে নাফাখুম জলপ্রপাত।
যেভাবে যাবেন:
বান্দরবান শহর থেকে ৭৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত থানচি উপজেলা সদরে চাঁন্দের গাড়িতে করে যেতে সময় লাগবে ৩ ঘণ্টার মতো। বর্ষায় ইঞ্জিনবোটে থানচি থেকে তিন্দু যেতে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা। আর তিন্দু থেকে রেমাক্রী যেতে লাগবে আরও আড়াই ঘণ্টা। শীতের সময় ইঞ্জিনবোট চলার মতো নদীতে যথেষ্ট গভীরতা থাকে না। তখন ঠ্যালা নৌকাই একমাত্র বাহন। রেমাক্রী বাজার থেকে দুইভাবে নাফাখুম যাওয়া যায়। এক ঘণ্টা উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে রেমাক্রী খালের পাড় ধরে বাকিটা হেঁটে প্রায় চার ঘণ্টা লাগে নাফাখুমে পৌঁছাতে। এছাড়া আবার পাহাড় না ডিঙিয়ে গোটা পথই রেমাক্রী খালের পাশ দিয়েও যাওয়া যায়।
৫. নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র:
নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র বান্দরবান জেলার নীলগিরি পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এটিকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উঁচুতে অবস্থানের কারণে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র প্রায় সবসময়ই মেঘমণ্ডিত থাকে। আর এটিই এই পর্যটন কেন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে নীলগিরি ধীরে ধীরে দেশব্যাপী মানুষের কাছে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। এই পর্যটন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশে সেনাবহিনী এবং তারাই এর পরিচালনা করে থাকে।
যেভাবে যাবেন:
নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রটি বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে কাফ্রুপাড়াসংলগ্ন পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত। বান্দরবানের আলীকদম থেকে থানচীগামী রাস্তা ধরে পাহাড়ি পথে নীলগিরি পৌঁছানো যায়।
সময় পেলে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবকে সাথে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন বান্দরবান থেকে। এখানকার অপার সৌন্দর্য বিমোহিত করবে আপনাকে।