রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির অবস্থান অপরিবর্তিত থাকার তিনটি কারণ উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ ইউএনবিকে বলেন, ‘এটা (চাপ জোরদার করা) খুবই প্রয়োজন।’
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হলেও সু চি রাখাইন রাজ্যে ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যা বন্ধে কিছু না করায় এবং দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর নিন্দা বা নৃশংসতার বিষয়টি স্বীকার করে নেয়া থেকে বিরত থাকায় ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন।
সু চির তার অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা না থাকার পেছনের তিনটি কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে এমন এক পদে আছেন যারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার জাতির অংশ হিসেবে মনে করে না।
দ্বিতীয়ত, তিনি বলেন, রোহিঙ্গা বিরোধী যা মুসলিমবিরোধী মনোভাবও সু চির প্রতি দেয়া সমর্থনের ভিত্তির এক উপাদান হিসেবে কাজ করে।
অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, তৃতীয়ত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাকে তার অবস্থান পরিবর্তন করতে দেবে না।
আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (এআইবিএস) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, ‘দেশটির ক্ষমতার আসল চাবি সামরিক বাহিনীর হাতে এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।’
বাংলাদেশ এর আগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসানের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল, বলেন তিনি।
দুর্ভাগ্যক্রমে, সাম্প্রতিক ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পুনরায় সম্পৃক্ততা অতোটা কাজে আসেনি উল্লেখ করে তিরি আরও বলেন, ‘এটি এখন কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রধান কাজ হয়ে উঠতে হবে।’
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারির পরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে কোনো আলোচনা করেনি মিয়ানমার বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।
যদিও রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে ও তারপরে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের কাছে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরেছিল বাংলাদেশ। তবে, সে প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে হ্যাঁ বা না কিছু বলেনি মিয়ানমার।
চাপ দেয়ার একটি মাপকাঠি
বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা করা অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রশাসন বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
গত ১১ জুলাই বৈদেশিক নীতি নিয়ে নিউইয়র্কে দেয়া জো বাইডেনের বক্তব্য এবং মার্চ মাসে ফরেন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত প্রবন্ধে লেখা নীতির ভিত্তিতে, এটা ধরে নেয়া যেতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র তার বিদেশ নীতিতে নতুন এক অধ্যায় চালু করবে, বলেন তিনি।
এ পররাষ্ট্র বিশ্লেষক বলেন, তাদের নতুন এ নীতির মূল ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং পরিবেশগত ন্যায্যতা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলোতে স্পষ্টতই রোহিঙ্গা ইস্যুও থাকবে।
এ ছাড়া অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব এবং মিয়ানমার ও চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে রোহিঙ্গা সমস্যা একটি চাপের বিষয় হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘তবে এটি বাংলাদেশ কি চায় তার উপরও অনেকটা নির্ভর করবে এবং বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করতে রাজি কিনা।’
ভারত ও চীনের ভূমিকা
মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোচনায় ভারত ও চীনের সম্পৃক্ততা ইতিবাচক কিছু আনবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের সম্পৃক্ততা থাকলে কিছু হওয়ার আশা করাই যায়।’
তিনি বলেন, ‘চীন যদি সৎ বিশ্বাসে যোগ দেয় এবং সৎ পক্ষ হিসেবে কাজ করে তবে কিছু অর্জনের আশা করা যায়।’
এ বিশ্লেষক বলেন, বিগত তিন বছরে চীন মিয়ানমারকে সঙ্কটের মূল কারণগুলো সমাধান করার ক্ষেত্রে ‘খুব কম আগ্রহই’ দেখিয়েছে।
তিনি বলেন, এর পরিবর্তে ‘মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীকে’ নিয়ে হওয়া আন্তর্জাতিক নিন্দা থেকে রক্ষা করেছে চীন।
সম্প্রতি ঢাকার চীনা দূতাবাস জানিয়েছে, ২০১৭ সালের পর থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিন দফায় মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক করেছে চীন এবং রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন সহজতর করার লক্ষ্যে অনেক দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ বাস্তবায়নের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।
এতে বলা হয়, ‘আমাদের রাজনৈতিক ও মানবিক প্রচেষ্টা বহু আগেই শুরু হয়েছিল ও স্থায়ী সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’
একই রকমভাবে অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার অবসানে ভারতও কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারেনি।
তবে ভারতীয় পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুতদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন দ্রুত, নিরাপদ ও স্থায়ীভাবে নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব সম্প্রতি বলেছেন, রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুতদের বিষয়ে তাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ের প্রতিবেশী হিসেবে এ ইস্যুতে ভারতের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ আছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) বৈঠকে বাংলাদেশ আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারত রোহিঙ্গা সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে নিরাপদে ও স্থায়ী উপায়ে মিয়ানমারে তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে আরও অর্থবহ ভূমিকা পালন করবে।
ঢাকার আশাবাদ
মিয়ানমারে নতুন সরকার গঠনের পর ত্রিপক্ষীয় উপায়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।
কোনো কালক্ষেপণ না করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় আলোচনা করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন।
এ জাতীয় ত্রিপক্ষীয় প্রথম সভা নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বিভিন্নভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও গত তিন বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও রাখাইনে ফিরিয়ে নেয়া হয়নি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে যার সমাধান মিয়ানমারের পক্ষ থেকে করা উচিত।
তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি ছাড়াও মিয়ানমার আরও জানায় যে তারা মিয়ানমারের পক্ষে কি কি কাজ করা হয়েছে তা নিয়ে একটি বুকলেট প্রকাশ করেছে এবং রাখাইনের পরিস্থিতি জানতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সে বুকলেট দেয়া হবে।
সাম্প্রতিক টেলিফোনে কথোপকথনের সময় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমার তাদের (চীন) আশ্বাস দিয়েছে।
সংবাদ সংস্থা এপি জানিয়েছে, মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দল সোমবার দাবি করেছে যে পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত আসনে তারা জয়ী হয়েছে।
দেশটির ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশন রবিবারের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার কাজ এখনও শেষ না করলেও তারা এটি দাবি করেছে।
এনএলডি তথ্য কমিটির মুখপাত্র মনইওয়া অং শিন বলেছেন, আমি এখন নিশ্চিত করতে পারি যে আমরা এখন ৩২২টিরও বেশি আসনে জয়ী হয়েছি। দেশটিতে ৬৪২টি সংসদীয় আসন রয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল আমরা মোট ৩৭৭টি আসন পাবো। তবে এর চেয়ে সম্ভবত আরও বেশি আমরা পাবো।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, পরিবর্তন না হলেও মিয়ানমারের নতুন সরকারকে স্বাগত জানাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বলেছে, ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগণকে যদি এ অপ্রত্যাশিত অবস্থায় পড়ে থাকতে হয় এবং স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ না পায় তবে তারা ‘আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার’ জন্য হুমকির কারণ হয়ে ওঠবে।
মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের ‘আস্থার অভাব’ এর মধ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বরের এবং ২০১৯ সালের আগস্টে করা দু’বারের প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ‘কাঠামোগত ব্যবস্থা’ তৈরিতে এক নথিতে স্বাক্ষর করেছে, যা রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ারপথ তৈরি করবে বলে মনে করা হয়েছিল।