কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সাতভিটার দোলা এলাকায় ১৫ বিঘা জমিতে আমন ধান রোপণ করা মুফতি আবুল হোসেন। টানা ভারী বর্ষণ ও বন্যায় তার পুরো খেত পচে নষ্ট হয়ে গেছে।
জেলার পাঁচ উপজেলায় শত শত হেক্টর আমন খেত পানিতে ভেসে গেছে। ফসল নষ্ট হওয়ায় বছরের খোরাক নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন কৃষকরা।
নিচু এলাকায় টানা ২০-২৫ দিন পানিতে ডুবে থাকায় মাঝারি বয়স্ক আমনের চারা গাছ পচে গেছে। পানি নেমে গেলেও আর সবুজ চারা দেখা যাচ্ছে না। তবে তুলনামূলক উচু অঞ্চলের ক্ষেতে চারা টিকে গেলেও ফলন নিয়ে কৃষকদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। ফলে আমন ধানে গোলা ভারা তো দূরের কথা, নিজেদের খাদ্যের যোগান নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন জেলার নিম্নাঞ্চলের চাষিরা।
কিছু আমন ক্ষেতে টিকে থাকা চারা গাছ দেখা গেলেও তা কচুরিপানাসহ বিভিন্ন আগাছায় ভরে উঠেছে। পানি কমে যাওয়ার পর খেতের আগাছা পরিষ্কার করতে শ্রমিকের পেছনে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে চাষিদের। এভাবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে আবহাওয়া ভালো থাকলে উঁচু অঞ্চলের আমন চাষিরা কিছুটা ধান পেলেও নিম্নাঞ্চলের চাষিদের গোলা শূন্যই থেকে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার চলবলা ইউনিয়নের আমন উৎপাদনের বড় এলাকা কয়ার দোলা, কালিকুড়ার দোলা, দলগ্রামের বুকশুলার দোলা, আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ও ভাদাই ইউনিয়নের স্বর্ণমতি সতি নদীর তীর, সলসলির দোলা, সাতভিটার দোলা, ভাদাই দোলা, পলাশীর মহিষাশ্বরের দোলা, সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর রেলগেটসহ তিস্তা ও ধরলা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের শত শত হেক্টর জমির আমন ধান খেত পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে। ভারী বৃষ্টি ও ধীর গতিতে পানি নামায় দীর্ঘদিন ডুবে ছিল এসব অঞ্চলের খেত।
চলবলা ইউনিয়নের কৃষক ছয়পাল মিয়া জানান, দুই বিঘা জমিতে আমন ধান রোপণের পর থেকে যাবতীয় পরিচর্যা শেষ করেছিলেন তিনি। কিছুদিন পরে ধানের শীষ বের হতো। এমন সময় টানা বৃষ্টিতে তার খেত পানিতে ডুবে যায়। টানা ২০ দিন ধরে ডুবে থেকে তার খেত নষ্ট হয়ে গেছে। এখন নতুন করে আর চারা রোপণের সুযোগ নেই। তার পরিবার পরিজন নিয়ে খাদ্য সংকটে ভুগতে হতে পারে বলে জানান তিনি।
কয়ার দোলার কৃষক মিন্টু মিয়া ও মোজাম্মেল হক জানান, অনেক টাকা খরচ করে রোপণ করা আমন খেত এখন কচুরিপানাসহ নানা জাতের আগাছা জমে ভরে গেছে। উঁচুতে থাকা আমন খেত কিছুটা রক্ষা পেলেও তাতে ফলন কম হবে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। নিজেদের খাদ্যের জন্য এসব খেতে কঠোর শ্রম বিনিয়োগ করছিলেন তারা।
প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে সহায়তা ও প্রণোদনার দাবি করেছেন এ কৃষকরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছর জেলায় ৮৫ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে চাষাবাদ হয় ৮৫ হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমিতে। যার মধ্যে সাড়ে তিন হাজার হেক্টর খেত পানিতে ডুবে যায়। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলার ১৩ হাজার ৬০৫ কৃষক। তাদের ৭৯৮ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে ক্ষতি হয়েছে আট কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এছাড়া সবজি ও বীজ বাদাম মিলে আরও সাড়ে ৬২ হেক্টর খেতের ফসল নষ্ট হয়েছে। জেলার মোট ১৬ হাজার ৪৭০ কৃষকের ৮৬০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে ১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তবে কৃষি বিভাগের এ তথ্য মানতে নারাজ কৃষকরা। তাদের দাবি এর চেয়েও দ্বিগুণ ক্ষতি হয়েছে।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শামীম আশরাফ বলেন, ‘টানা বৃষ্টি আর বন্যায় দীর্ঘদিন আমন ও সবজি খেত পানিতে ডুবে থাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নতুন করে আমন রোপণের কোনো সুযোগ নেই। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের রবি শস্য চাষের প্রস্তুতি নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ক্ষতির পরিমাণসহ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রণোদনা বা কোনো সহায়তা এলে তা কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে।’