হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় অগ্রগতির মধ্যেই গাজা উপত্যকার দক্ষিণ করিডরে সৈন্য রাখার শর্ত দিয়েছে ইসরায়েল। এই প্রস্তাব যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌছানোর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৮ জুলাই) মার্কিন, ইসরায়েলি ও কাতারি শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি আলোচনায় এই সেনা মোতায়েনের প্রসঙ্গটি উঠে আসে।
সম্প্রতি প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় ৬০ দিন যুদ্ধ স্থগিত রাখার কথা রয়েছে। এই সময়ে কিছু জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং গাজায় আরও ত্রাণ প্রবেশ করবে।
তবে এরই মধ্যে ইসরায়েল নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়ায় এই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলোচনা-সংশ্লিষ্ট এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) জানিয়েছেন, ৬০ দিনের সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির সময় ইসরায়েল তাদের সেনা মোতায়েন রাখবে। বিশেষত ইসরায়েলের কাছে ‘মোরাগ করিডর’ হিসেবে পরিচিত পূর্ব-পশ্চিম করিডরে সেনা মোতায়েনের কথা জানিয়েছেন তিনি।
মূলত, মোরাগ করিডরে উপস্থিতি বজায় রাখার মাধ্যমে কয়েক লাখ ফিলিস্তিনিকে গাজার দক্ষিণে সীমান্তঘেঁষা একটি সংকীর্ণ এলাকায় ঠেলে নিয়ে যেতে চায় ইসরায়েল, যেটিকে তারা ‘মানবিক শহর’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তাছাড়া অনেকে মনে করছেন, এই পদক্ষেপ আসলে গাজার প্রায় ২০ লাখ মানুষকে জোরপূর্বক সরিয়ে নেওয়ার পূর্বাভাস, যেটি এই ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনারই অংশ।
বুধবার (৯ জুলাই) রাতে দেওয়া এক বিবৃতিতে হামাস জানিয়েছে, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এখনও আলোচনার প্রধান অন্তরায়। তবে তারা মোরাগ করিডরের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেনি। অবশ্য গাজা থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার না করলে কোনো চুক্তি না করার কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে হামাস।
আরও পড়ুন: অগ্রগতি ছাড়াই শেষ ইসরায়েল-হামাসের যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের আলোচনা
এর আগেও ইসরায়েল ভিন্ন আরেকটি করিডরে সৈন্য রাখার শর্ত দেওয়ায় কয়েক মাস ধরে যুদ্ধবিরতির অগ্রগতি আটকে ছিল। তবে মোরাগ করিডরের ভূমিকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয়।
চলতি সপ্তাহে ওয়াশিংটন সফরে যান নেতানিয়াহু। সেখানে যুদ্ধবিরতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। হামাস ও ইসরায়েল উভয় পক্ষকে গাজায় যুদ্ধ থামাতে চাপ দিয়ে আসছেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, মঙ্গলবার মার্কিন, ইসরায়েলি ও কাতারি শীর্ষ কর্মকর্তাদের আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল গাজায় সেনা রাখা।
পরে বুধবার এই আলোচনা-সংশ্লিষ্ট এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই। আমরা জিম্মিদের ফিরে পেতে চাই। আর আমার মনে হচ্ছে, আমরা সেই লক্ষ্য থেকে খুব একটা দূরে নেই।’
গাজা ভাগ করা তিন করিডরের একটি মোরাগ
চলমান আগ্রাসনে গাজার বেশিরভাগ ভূমি দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি পূর্ব-পশ্চিম করিডর, যেগুলো গাজা উপত্যকাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মোরাগ করিডরের দখল নেয় ইসরায়েল। ২০০৫ সালে গাজা ছেড়ে যাওয়ার সময়কার বসতি ‘মোরাগের’ নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে।
গাজার দক্ষিণে রাফাহ শহর ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খান ইউনিসের মাঝখানে অবস্থিত এই করিডরটি প্রায় ১২ কিলোমিটার বা ৭ মাইল দীর্ঘ, যা ইসরায়েল সীমান্ত থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রস্থে প্রায় ১ কিলোমিটার বা অর্ধ মাইল।
নেতানিয়াহু মোরাগ করিডরকে ‘দ্বিতীয় ফিলাডেলফি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ফিলাডেলফি গাজার সঙ্গে মিসরের সীমান্ত বরাবর আরেকটি করিডর।
আরও পড়ুন: যুদ্ধবিরতি আলোচনার মধ্যেও গাজায় ৩৮ ফিলিস্তিনি নিহত
ইসরায়েল বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছে, সীমান্তপারের অস্ত্র চোরাচালান ঠেকাতে ফিলাডেলফি করিডরে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। কিন্তু তাদের সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র গাজায় প্রবেশ করার বিষয়টি বরাবর অস্বীকার করেছে মিসর।
গত মার্চে প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ার পর ইসরায়েল ফের নেতজারিম করিডরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। গাজার উত্তরের এক-তৃতীয়াংশ এলাকাকে বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে ওই করিডরটি। এই স্থান দিয়ে এর আগেও উত্তর গাজায় ফিলিস্তিনিদের ফিরে যাওয়া ঠেকিয়েছিল ইসরায়েল।
তবে নেতজারিম ও ফিলাডেলফি করিডরে ইসরায়েলি সেনা উপস্থিতির বিষয়টি বর্তমানে চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনায় কতটা প্রভাব ফেলছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে পরিষ্কার হয়নি।
রাফাহকে ‘মানবিক শহর’ বানানোর পরিকল্পনা
মোরাগ করিডরে ইসরায়েলি সেনারা অবস্থান নেওয়ার ফলে রাফাহ শহর গাজার বাকি অংশ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
এদিকে, ইসরায়েলের আগ্রাসনে কয়েক হাজার মানুষের শহর রাফাহ এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত। শহরটি এরই মধ্যে ইসরায়েলি উচ্ছেদ আদেশে জনশূন্য হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই রাফাহকে হামাসমুক্ত ‘নিরাপদ অঞ্চল’ বা ‘নিরস্ত্র এলাকা’ বানানোর দাবি তুলেছে ইসরায়েলে। সেখানে তারা লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে সরিয়ে নিতে চায়, যার নাম দিয়েছে মানবিক শহর।
গাজার বেশিরভাগ মানুষ যুদ্ধের সময় বারবার নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। ছোট ছোট এলাকায় ঠাসাঠাসি করে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, দক্ষিণে সরানোর এই নতুন পরিকল্পনা মূলত জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতিরই আরেকটি ধাপ।
ইসরায়েলের নিরাপত্তা–সম্পর্কিত দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ গবেষক কোবি মাইকেল জানান, মোরাগ করিডরটিকে ব্যবহার করা হবে এক ধরনের ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষার এলাকা’ হিসেবে। যাদের দক্ষিণে সরানো হবে, তাদের মধ্যে হামাস যোদ্ধারা আছে কি না—তা শনাক্তের জন্য এটি ব্যবহার করা হবে। এতে ইসরায়েলি বাহিনী আরও উত্তরে অভিযানে সুবিধা পাবে এবং ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষদের সেখানে সংঘর্ষের মুখে পড়তে হবে না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: খাবারের অভাবে হাড্ডি-চর্মসার হয়ে গেছে গাজার শিশুরা: চিকিৎসক
মাইকেল আরও বলেন, ‘এই পরিকল্পনার মাধ্যমে ইসরায়েল হামাসের ওপর চাপ আরও বাড়াতে পারবে এবং সম্ভব হলে উত্তর গাজায় হামাসকে পরাজিতও করতে পারবে, যেখানে গেরিলা যুদ্ধ এখনও ইসরায়েলি সেনাদের ভোগাচ্ছে।’
এর মাধ্যমে যুদ্ধ শেষের পথ তৈরি হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। যদিও ইসরায়েল বলছে, হামাস ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ থামবে না।
তবে ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণে সরানোর এই পরিকল্পনা আসলে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বের করে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করছে বলে মনে করেছেন এই প্রস্তাবের সমালোচকরা। তাদের আশঙ্কা, এর মাধ্যমে গাজায় ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি দখল প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হবে—যেটি নেতানিয়াহুর ডানপন্থী জোটের প্রধান এজেন্ডাগুলোর একটি।
অবশ্য এই স্থানান্তর জোরপূর্বক হবে না বলে দাবি করেছেন নেতিনিয়াহু। তবে যে এলাকায় যুদ্ধের ভয়াবহতা চরমে, সেখানে এত মানুষকে জড়ো করলে অবকাঠামোহীন দুর্বিষহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন ফিলিস্তিনিরা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাছাড়া, এতে ফিলিস্তিনিরা গাজা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের ফিলিস্তিন-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাইকেল মিলস্টেইন মোরাগ করিডর ব্যবহার করে দক্ষিণে ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের পরিকল্পনাকে একটি ‘উদ্ভট কল্পনা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘এই ইসরায়েলি শর্তে বর্তমান আলোচনাও ভেঙে পড়তে পারে। কারণ এতে হামাস নিশ্চিত হবে যে, যুদ্ধবিরতি শেষ হলেও ইসরায়েল সেনা সরাবে না, যা হামাস কোনোভাবেই মেনে নেবে না।’
তিনি বলেন, ‘হামাসের জন্য এটি একেবারেই অসম্ভব শর্ত। যদি এটাই শর্ত হয়, তাহলে আমি হামাসের পক্ষ থেকে সম্মতি দেখতে পাচ্ছি না।’