ভারত সরকার তাদের কূটনৈতিক নিরাপত্তা (ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটি) প্রত্যাহারের পরে ভারত থেকে ৪১ জন কূটনীতিককে প্রত্যাহার করেছে কানাডা। বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত জুন মাসে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে দেশটির নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত থাকতে পারে বলে কানাডার অভিযোগের জেরে দুই পক্ষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধের কারণে সর্বশেষ এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ভারত কানাডাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ‘সন্ত্রাসীদের’ আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করেছে। তবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগটিকে ‘অযৌক্তিক’ বলে নাকচ করেছে এবং অভিযোগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি বৃহস্পতিবার বলেছেন, ভারতে থাকা কানাডার ৬২ কূটনীতিকের মধ্যে ৪১ জনকে তাদের পরিবারসহ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জোলি বলেন, বাকি ২১ কানাডিয়ান কূটনীতিক ভারতে থাকবেন।
জোলি বলেন, ‘৪১ জন কানাডিয়ান কূটনীতিক এবং তাদের পরিবারের ৪২ জন সদস্য তাদের কূটনীতিক নিরাপত্তা প্রত্যাহারের ঝুঁকিতে ছিলেন। এটি প্রত্যাহারে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কূটনীতিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা ফিরে এসেছেন।’
আরও পড়ুন: ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কানাডা: ট্রুডো
জোলি বলেন, কূটনৈতিক নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নেওয়া বিষয়টি নতুন নয়, কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। তবে এ কারণে কানাডা ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে একই জিনিস করার হুমকি দেবে না।
জোলি বলেন, ‘কূটনৈতিক বিশেষাধিকার ও মর্যাদার একতরফা প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি করার হুমকি দেওয়া অযৌক্তিক ও উসকানিমূলক।’
জোলি বলেন, ভারতের সিদ্ধান্ত উভয় দেশের নাগরিকদের পরিষেবাপ্রাপ্তিকে প্রভাবিত করবে।
তিনি বলেন, চণ্ডিগড়, মুম্বাই ও ব্যাঙ্গালোরে ব্যক্তিগত পরিষেবা বন্ধ করে দিচ্ছে কানাডা।
কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি ভারতে কানাডিয়ান কূটনীতিকদের সংখ্যা কমানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, কানাডায় ভারতের কর্মকর্তাদের চেয়ে ভারতে কানাডার কর্মকর্তাদের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত মাসে বলেছিলেন, ভ্যাঙ্কুভারের বাইরে সারেতে জুন মাসে মুখোশধারী বন্দুকধারীদের হাতে নিহত ৪৫ বছর বয়সী শিখ নেতা নিজ্জার হত্যায় ভারতীয় জড়িত থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’ রয়েছে।
কয়েক বছর ধরে ভারত অভিযোগ করে আসছে, ভারতে জন্মগ্রহণকারী কানাডিয়ান নাগরিক নিজ্জার সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত।
তবে নিজ্জার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
আরও পড়ুন: ভারতের বিশাল কৌশলগত গুরুত্বের তুলনায় কানাডার স্বার্থ ফিকে: বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বিবিসি
ভারত কানাডিয়ানদের ভিসাও বাতিল করেছে, তবে কানাডা এজন্য প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
এর আগে কানাডা একজন সিনিয়র ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করার পরে, ভারতও কানাডার একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল।
তবে ট্রুডোকে কূটনৈতিক বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করতে দেখা গেছে।
তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, কানাডা ‘উসকানি বা উত্তেজনা বাড়াতে চাইছে না।’
একজন কানাডিয়ান কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) বলেছিলেন, কানাডায় ভারতীয় কূটনীতিকদের নজরদারির মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার তথ্য জানা গেছে।
এছাড়া, তাদের প্রধান মিত্রদের নিয়ে গঠিত একটি গোয়েন্দা বাহিনীও একই তথ্য জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ফাইভ আই’ গোয়েন্দা-শেয়ারিং জোট এ বিষয়ে কিছু গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছিল। ‘ফাইভ আই’ গোয়েন্দা শেয়ারিং জোটে কানাডা ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড রয়েছে।
ভারতের সর্বশেষ কূটনৈতিক বহিষ্কারের পদক্ষেপ এই দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে।
নয়াদিল্লিতে সাম্প্রতিক গ্রুপ অব ২০ বৈঠকের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রুডোর হিমশীতল কথোপকথন হয়।
এর কয়েকদিন পরে, ভারতে একটি বাণিজ্য মিশন বাতিল করে কানাডা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন উত্তপ্ত দ্বন্দ্বের মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, অভিযোগের বিষয়টি ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
নিজ্জার খালিস্তান নামে পরিচিত একটি স্বাধীন শিখ আবাসভূমি তৈরির আন্দোলনের এক সময়ের শক্তিশালী একজন নেতা ছিলেন।
১৯৭০ থেকে ১৯৮০’র দশকে একটি রক্তাক্ত শিখ বিদ্রোহ উত্তর ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেসময় দেশটিতে শিখ নেতাসহ হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।
খালিস্তান আন্দোলন তার রাজনৈতিক শক্তি হারিয়েছে। কিন্তু এখনও ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে এবং বিভিন্ন দেশে এ আন্দোলনের সমর্থক শিখ রয়েছে।
কয়েক বছর আগে সক্রিয় বিদ্রোহ শেষ হওয়ার সময় ভারত সরকার বারবার সতর্ক করেছে যে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ফিরে আসার চেষ্টা করছে।
কানাডার অভিবাসন মন্ত্রী মার্ক মিলার উল্লেখ করেছেন, ২০২২ সালে ভারত কানাডায় স্থায়ী বাসিন্দা, অস্থায়ী বিদেশি কর্মী এবং আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য শীর্ষ দেশ ছিল।
মিলার বলেন, কূটনীতিকদের মর্যাদা অপসারণের ভারতের সিদ্ধান্তের ফলে কানাডার অভিবাসন বিভাগ ভারতে কানাডিয়ান কর্মীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে।
মিলার আরও বলেন, শ্রমিকদের ভিসা ও পারমিট প্রদানেও বাধা সৃষ্টি করবে।
ঊর্ধ্বতন কানাডিয়ান কর্মকর্তারা বলেছেন, ভারত কানাডিয়ান কূটনীতিকদের সংখ্যা এবং কূটনৈতিক মর্যাদা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় ছিল।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারত আরও ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা বিভিন্ন পারমিট বাতিল করবে। যেমন- কূটনীতিকদের স্বামী/স্ত্রীকে ভারতে কাজ করার অনুমতি দেওয়া এবং গাড়িতে কূটনৈতিক প্লেট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নেলসন ওয়াইজম্যান বলেছেন, কানাডার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভারত সর্বশেষ যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা অর্থহীন।
ওয়াইজম্যান বলেছেন, ‘কানাডিয়ান কূটনীতিকদের বহিষ্কার ভারতীয়দের বিচলিত মানসিকতা প্রকাশ করে; এতে বোঝা যায় যে তারা জানে যে তারা কানাডায় একজন কানাডিয়ান হত্যার সঙ্গে জড়িত।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা হত্যার তদন্তে কানাডার সঙ্গে তাদের সহযোগিতার অভাব থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করছে।’