তার প্রথিতযশা হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে মূলত বিশ্ব অর্থায়ন প্রযুক্তিতে বা ফিনটেক শিল্পে তার অবাক করা অবদান। পুরুষতান্ত্রিক কর্মব্যবস্থা উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি খাতে একজন নারী হিসেবে নিজের অবস্থানটা খুব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। চলুন, তার সেই সাফল্যের গল্পটা জেনে নেয়া যাক।
এমআইটিতে পড়াশোনার সুযোগ লাভ
পশ্চিমের স্বনামধন্য প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমআইটি শাম্মী কুদ্দুসের সামনে সমূহ সম্ভাবনার দরজার খুলে দিয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের যে কোনো মেয়ের পক্ষে দেশের বাইরে যেয়ে পড়াটা খুব কঠিন। এরপরেও শিক্ষক বাবা-মার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হন শাম্মী। তথাকথিত নিয়মের বাইরে যেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার একজন মেয়ে হয়ে তিনি মার্শাল আর্ট রপ্ত করেন। তিনি কারাতে ও তাইকোয়ান্দোতে ব্ল্যাক বেল্ট ধারী।
অতঃপর স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন বড় বড় শহরগুলোতে। সর্বোপরি, গতানুগতিক পেশায় না যেয়ে বেছে নেন নিজের মনের মত একটি পেশা।
নারীদের প্রতি সমসাময়িক প্রতিকূলতা থাকার পরেও তিনি এতসব করতে সমর্থ হন পারিবারিক সমর্থন এবং নিজের প্রতি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ও মনোবলের কারণে।
আরও পড়ুন: দেশের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনুঘটক হিসেবে আবির্ভূত কোভিড
হাইস্কুলেই তিনি স্যাট ওয়ান ও টু পরীক্ষা দিয়ে ফেলেন। তারপর স্কলারশিপের জন্য আমেরিকার ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। এগুলোর বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শাম্মী স্কলারশিপ পেয়ে যান। আর সাথে সাথেই অবিলম্বে বেছে নেন নিজের স্বপ্নের ইউনিভার্সিটি এমআইটি। বিশেষত এটিই ছিল তার সফলতার পথে এগোনোর প্রথম পদক্ষেপ।
সরাসরি ভোক্তা সম্পৃক্ত কাজে যোগদান
এমআইটি থেকে পরিবেশ প্রকৌশলে বিএসসি করার পর প্রথমে শাম্মী কাজ শুরু করেছিলেন বহুজাতিক অবকাঠামোগত ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএম-এ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। এখানে তাকে ডেটা বিশ্লেষণের মত তাত্ত্বিক কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। কিন্তু শাম্মীর ইচ্ছা ছিল সরাসরি মানুষের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে এমন কিছু কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখা। আর এরই ফলশ্রুতিতে তিনি ২০১১ সালে ওয়াটারহেল্থ্ ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ টিমের সাথে কাজ করা শুরু করেন। সে সময় টিমটি চট্টগ্রামেরই খাবার পানির ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেছিল। অতঃপর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-প্রযুক্তি খাতে সামাজিক নতুন সংগঠন জিওন-এর সাথে কাজ করেন। তার মাধ্যমে জিওনের প্রথম টেলিমেডিসিন পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসময় তার বাস্তবায়ন করা প্রযন্ত মোবাইল টেলিমেডিসিন সেবাটি দক্ষিণ এশিয়ায় বছরের সবচেয়ে উদ্ভাবনীয় মোবাইল অ্যাপ সেবা হিসেবে ইউএসএআইডি এমফোরডি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভাব
২০০৮-এর শুরুতে শাম্মী কুদ্দুস স্বামী এজাজ আহমেদের সাথে ইংরেজী, বাংলা এবং আরবি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মতবিনিময় এবং সক্রিয় নাগরিকত্ব প্রচারের লক্ষ্যে গঠন করেন তরুণ নেতৃত্ব নির্ভর প্রোগ্রাম- বিওয়াইএলসি। এ সময় তিনি এমআইটির ‘শান্তির জন্য ডেভিস প্রকল্পসমূহ’ নামে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক কলেজিয়েট সামাজিক উদ্ভাবন অনুদান জিতে বিওয়াইএলসির জন্য প্রাথমিক তহবিলের ব্যবস্থা করেন। উন্নয়ন সাধন করেন অংশীদারিত্ব ও পাঠ্যক্রমের। প্রোগ্রামে শিক্ষার্থীদের যোগদান সুনিশ্চিত করেন যাদের ৯৩ শতাংশ স্নাতক সম্পন্ন করে। ফলশ্রুতিতে, প্রোগ্রামটি দেশের শীর্ষস্থানীয় লিডারশীপ ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন: পুঁজিবাজারে গতি আনতে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
এরই সূত্র ধরে বিভিন্ন বহুজাতিক কন্সাল্টেন্সি ফার্মে কাজ করার সুবাদে নতুন নতুন অনেক প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করাতে শাম্মীকে পালন করতে হয়েছে প্রয়োজনীয় ভূমিকা। প্রান্তিক ভোক্তাদের সাথে আলোচনা, মার্কেটিং ক্যাম্পেইন, জমির মালিকদের সাথে কারবার, বিদ্যুৎ অনুমোদন আনা ও নিয়োগের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি সহ বিভিন্ন কাজের সাথে তাকে জড়িত হতে হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে তার মধ্যে গড়ে ওঠেছে নেতৃত্ব দান এবং বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে পারস্পরিক বোঝাপড়া করার ক্ষমতা।
গুগল কর্মী হিসেবে শাম্মী কুদ্দুসের পথচলা
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কাজ করা সত্ত্বেও শাম্মী ভেতরে ভেতরে এক রকম টান অনুভব করেন উন্নয়ন খাতে কাজ করার প্রতি। তাই নেতৃত্বদান ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কিত জ্ঞানলাভের জন্য এমবিএ করেন। অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি-নির্ধারণীতে দক্ষতা অর্জনের জন্য শেষ করেন এমপিএ। এরপরই ডাক আসে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় তথ্য নির্ভর প্রতিষ্ঠান গুগল ইনকর্পোরেশন থেকে। প্রথমে কাস্টোমার ইন্সাইট্স ম্যানেজার হিসেবে বছর দেড়েক কাজ করেন। তারপর অন্তর্ভুক্ত হন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম টিমের পণ্য ব্যবস্থাপক হিসেবে। গুগলের সকল প্রকার নগদীকরণ প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করা এই টিমটির দায়িত্ব। অর্থাৎ গুগলের সাথে গ্রাহকদের সকল ধরনের আর্থিক লেনদেন তাদের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। বিশ্ব জুড়ে ইউটিউব, ম্যাপ্স, অ্যাড্স, প্লে-স্টোর, অ্যাডসেন্স ইত্যাদি গুগল পণ্যসমূহের ব্যবহার তাদেরকে সুনিশ্চিত করতে হয়।
পণ্য ব্যবস্থাপক হিসেবে শাম্মীকে প্রতিটি পণ্যের ব্যাপারে ব্যবহারকারীর চাহিদা, প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতা, নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিনিষেধ, রাজস্ব প্রভাব, গুগলের লক্ষ্য ইত্যাদি বুঝে প্রযুক্তিগত বাস্তবায়নের নকশা করার ক্ষেত্রে প্রোগ্রামারদেরকে পরামর্শ দিতে হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, শাম্মী এ পর্যন্ত যত কাজ করেছেন সেগুলোর মধ্যে গুগলের এই কাজটাই তাকে সর্বাধিক আনন্দ দেয়।
২১ শতকে নারী নেতৃত্ত্বের পথিকৃৎ শাম্মী কুদ্দুস
শাম্মী মনে করেন, যেকোনো সংস্থায় উচ্চপদে নারী-পুরুষের সমতা রাখার পাশাপাশি প্রাথমিক স্তরেও সম সংখ্যক নারী-পুরুষ নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, পক্ষপাতিত্ব উপেক্ষা করে সর্বস্তরে নারী-পুরুষকে সমানভাবে উপস্থাপন করলে লিঙ্গ বৈষম্য দূর হবে।
বাংলাদেশে যেমন নারীরা খেলাধুলার সুযোগ পায় না বিধায় তারা নিজের শরীর নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে। কিন্তু শাম্মী মার্শাল আর্টের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহ থেকে চট্টগ্রামে ১৬ বছর বয়সেই কারাতে প্রশিক্ষণ নেন এবং ব্ল্যাক বেল্টও পেয়ে যান। এমনকি বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়েও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি এ ধরনের আউটডোর কর্মকান্ডের ফলে তিনি হয়ে ওঠেন আরো বেশী আত্মবিশ্বাসী। এমআইটিতে যেয়েও তিনি তাইকোয়ান্দো ট্রেইনিং নেন এবং চার বছরেই ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করেন।
আরও পড়ুন: গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ই-কমার্স বাস্তবায়নে চুক্তি সই
ক্যারিয়ারের পাশাপাশি শাম্মী পারিবারিক জীবনকেও সমান গুরুত্ব দেন। শাম্মীর মতে, সারা দিনে ২৪ ঘণ্টাই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়। সিদ্ধান্তগুলো নিতে হয় পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। কখনো আগে থেকেই ফিফটি-ফিফটি ভেবে রাখা যায় না। কখনো ৮০ ভাগ দেয়ার পর পাওয়া যাবে ২০ ভাগ। আবার কখনো ২০ শতাংশ দিতেই ৮০ শতাংশ লাভ হবে। আর এটা মেনেই জীবনে ভারসাম্য রাখা সম্ভব।
তার সফলতার পথে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তগুলো
শাম্মীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এমআইটিতে ফুল ফ্রি স্কলারশিপে পড়তে পারা। আর এই ১৫ বছর পরেও সেই স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টাগুলো এখনো তিনি স্মরণ করেন। অবশেষে ইনবক্সে দেখা এমআইটির ইতিবাচক ইমেইল পাওয়ার আনন্দ কখনো ম্লান হওয়ার নয়।
তারপর হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ডের মত দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন পরিবেশে পড়তে যাওয়াটা শাম্মীর জন্য অনেক কঠিন ছিল। কেননা স্বামী ও সন্তানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা তার জন্য অনেকটা হিমালয় পাড়ি দেয়ার মত ছিল। এ সময় ছায়া হয়ে পাশে ছিলেন স্বামী বিওয়াইএলসির প্রতিষ্ঠাতা এজাজ আহমেদ।
আরও পড়ুন: সোশ্যাল মিডিয়া কমার্সে তরুণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে: প্রতিমন্ত্রী
শেষ কথা
শাম্মী কুদ্দুস এখন স্বপ্ন দেখেন ভবিষ্যতে অর্থপ্রযুক্তি শিল্পে নতুন পণ্য তৈরি করার। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের আরো বেশী অংশগ্রহণ প্রয়োজন। প্রত্যেকেরই উচিত যার যার জায়গা থেকে যতটুকু পারা যায় প্রযুক্তি নির্ভর সেবা তৈরিতে এগিয়ে আসা। কাজের জায়গায় যদি ভালো লাগার পরিবেশ তৈরি করা যায় তাহলে জন্ম নেবে সৃজনশীলতার। আর তখনিই কল্যাণ সাধিত হবে বৃহত্তর স্বার্থে।