বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি কম, আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি একেবারেই নেই।
মুক্তিযুদ্ধে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমিকা বিষয়ক গবেষক সিহাবুল ইসলামের গবেষণায় এমনটাই উঠে এসেছে।
বুধবার ইউএনবিতে সম্প্রচারিত আলোচনা অনুষ্ঠান ‘দখল দেশে: গণহত্যা ও ৭১’ সিরিজের তৃতীয় পর্ব ‘নারী ও ৭১’ এ অতিথি হিসেবে ছিলেন সিহাবুল ইসলাম। তরুণ প্রজন্মের এই গবেষক মুক্তিযুদ্ধে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে হিন্দু জনগোষ্ঠী ও নারীদের ওপর পাক বাহিনীর চালানো বহুমাত্রিক নির্যাতন এবং মুক্তিযুদ্ধে এই দুই জনগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক অবদান নিয়ে দুটি সমৃদ্ধ বই রচনা করেছেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নির্মম গণহত্যা নিয়ে ‘দখল দেশে: গণহত্যা ও ৭১’ শিরোনামের চার পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে ইউএনবিতে। এর আগে ১৬ ডিসেম্বর সম্প্রচারিত হয়েছে এই সিরিজের প্রথম পর্ব ‘পাকিস্তান ও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পরাজয়’ এবং ২৩ ডিসেম্বর সম্প্রচারিত হয়েছে এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব ‘গণহত্যা ও ৭১’।
আরও পড়ুন: গণহত্যা নিয়ে ইউএনবিতে আলোচনা অনুষ্ঠান
চার পর্বের এই আলোচনা অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করছেন ইউএনবি’র এডিটর এট লার্জ আফসান চৌধুরী। তিনি একজন শিক্ষক, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাংবাদিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন আফসান চৌধুরী।
গবেষণা করতে গিয়ে সিহাবুল ইসলাম দেখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি কম, আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি একেবারেই নেই। এমনকি তাদের ওপর চলা নির্যাতনের চিত্রও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় তেমন উঠে আসেনা।
এ ব্যাপারে তিনি বলেন, তেমনি এদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীদের ওপর পাকবাহিনীর চালানো বহুমাত্রিক নির্যাতনের চিত্রও আমাদের মূলধারার ইতিহাস চর্চায় উঠে আসেনি। আমাদের পত্র-পত্রিকা, পাঠ্য বই;কোথাও আমরা এইসব বিশদ ইতিহাস খুঁজে পাইনা।
গবেষক এ জন্য আমাদের গবেষকদের মানসিকতার পশ্চাদপদতাকে দায়ী করেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস জানতে গ্রামে যেতে হয়, আমাদের গবেষকরা এই কষ্টটা করতে চান না। গুগল-উইকিপিডিয়ার এই যুগে তারা,সহজ পন্থা অনুসরণ করতেই স্বাচ্ছন্দ্য করেন।
তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আবার গবেষক আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন না।
সঞ্চালক আফসান চৌধুরীর করা এক প্রশ্নের জবাব আলোচক সিহাবুল ইসলাম আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নারীর ওপর ধর্ষণ ছাড়াও বহুমাত্রিক নির্যাতন হয়েছে। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী; এই নারীদের প্রকৃত ইতিহাস এই পঞ্চাশ বছরেও অদৃশ্য হয়ে আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ইতিহাস ১০-২০ শতাংশও উঠে আসেনি।
আরও পড়ুন: জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ
মুক্তিযুদ্ধে নারীর কথা বললেই আমাদের প্রচলিত গবেষণাগুলোতে শুধু শারিরীক নিপীড়নের কথাই উঠে আসে। কিন্তু নারীর অবদান শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ না। নারী সেসময় যেমন শারিরীকভাবে নির্যিাতিত হয়েছে, তেমনি অনেক নারী সরাসরি যুদ্ধ করেছে, অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। এছাড়া সেসময় অধিকাংশ সংসারের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে নারীরা। তারা ধান কেটেছে, শ্রমিক হিসাবে কাজ করেছে আরও বহু কাজ করে সমাজটাকে টিকিয়ে রেখেছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতো নারীদের অবদানও আমাদের ইতিহাস চর্চায় না উঠে আসার কারণ হিসাবে আলোচক আমাদের গবেষকদের লিঙ্গ বৈষম্যমূলক মনোভাবকে দায়ী করেন।
সবশেষে আমাদের মূলধারার ইতিহাস চর্চায় হিন্দু ও নারীদের তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস তুলে ধরার জন্য গবেষক সিহাবুল ইসলাম এ সময়ের তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহ্বান করেন। লেখা, গবেষণা, সিনেমা, অডিও-ভিডিও বিভিন্ন মাধ্যম কাজে লাগিয়ে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তুলে ধরা উচিত। তিনি বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এই গুরু দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের হাতেই পুরো ইতিহাস চর্চার ভাগ্য নির্ধারণী পড়ে আছে। তাদের চেষ্টায়ই আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলো আমাদের ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে গণহত্যার ‘স্বীকৃতি’ আদায়ে আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান