ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ কালু সোমবার মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
বার্ধক্যজনিত কারণে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে তার ছেলে মো. সোহাগ নিশ্চিত করেছেন।
ইউসুফ সম্মুখ সারিতে থেকে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ জন্মের সংগ্রামে লড়েছিলেন। সেই সাথে এই প্রজন্মের জন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভাষা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে সক্রিয় ছিলেন তিনি। তার জন্ম ১৯৩১ সালের ১৭ জানুয়ারি ঝালকাঠী জেলার রাজাপুরের কানুদাসকাঠী মিয়াবাড়িতে। বাবা ওবায়দুল করিম (রাজা মিয়া) ও মা ফাতেমা খাতুন। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
আরও পড়ুন: সাংবাদিক আনাস মারা গেছেন
ইউসুফ কালুর হাতেখড়ি পাঠশালায়। সংগঠন শুরু শিশু কিশোরদের মুকুলফৌজ দিয়ে। তিনি বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের (বিএম স্কুল) ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ভাষা আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। মেট্রিকুলেশন পাস করে ১৯৫১ সালে আইএ ভর্তি হন বিএম কলেজে কমার্স বিভাগে। এই সময়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ও বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়াকে আহ্বায়ক করে বিএম কলেজে ২৫ সদস্যের ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন হয়। সেই কমিটির সদস্য ইউসুফ কালু। আন্দোলনের গতি বাড়লে সেই কমিটির কলেবর বৃদ্ধি করে ৮১ সদস্য বিশিষ্ট বৃহত্তর বরিশাল ভাষা সংগ্রাম পরিষদ করা হয়।
আরও পড়ুন: ভাষা সৈনিক দেবপ্রিয় বড়ুয়া আর নেই
১৯৫৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বরিশালে প্রচারণায় আসেন তৎকালীন পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খান আব্দুল কাইউম। কাইউমকে ঠেকাতে কালো পতাকা মিছিলসহ আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নেন কালু। ওই মিছিলে পুলিশের সাথে সংর্ঘষে কাউনিয়ার বাসী মালেক নামে একজন নিহত ও ইউসুফ কালুসহ ৩৫ জন গ্রেপ্তার হন। ২২ দিন পর জামিন পেয়ে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ শুরু করেন।
৬৯’র গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি আন্দোলনেই দেশ ও মানুষের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করেন তিনি। ৭১ সালের ১৪ মে কলকাতা লালবাজারে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সহযোগিতায় হাসনাবাদ, হিংগলগড়, টাকি হেড কোয়ার্রের প্রশিক্ষণ নেন। দেশে ফিরে ৯নং সেক্টরের অধীনে কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন নুরুল আলম ফরিদ সম্পাদিত রণাঙ্গনের মুখপত্র ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকার পরিচালকদের একজন ছিলেন। শিক্ষা জীবনের প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন তিনি। ৫২ সালে যোগ দেন ছাত্রলীগে। তিনি স্বৈরাচার বিরোধী ও প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রথমে আজাদ ও পরে দৈনিক পয়গামের বরিশাল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন । ওই একই সময়ে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল খেলায় পারদর্শী তিনি বরিশাল ক্রীড়া সংস্থারও সদস্য ছিলেন।
আরও পড়ুন: ভাষা সৈনিক প্রফেসর লায়লা নূর আর নেই
ইউসুফ কালুর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দারসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।