কিশোরগঞ্জ থেকে অপহরণ, চলন্তগাড়িতে কুমিল্লায় শ্বাসরোধ করে হত্যা, এরপর চট্টগ্রামের পটিয়ায় এনে লাশ ফেলা হয় নবী হোসেন নামে এক ব্যক্তির। প্রথমে অজ্ঞাত হিসেবে পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে। পরে অত্যাধুনিক ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন এন্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম’ এর মাধ্যমে ভুক্তভোগীর পরিচয় জানার পর হত্যার রহস্য উদঘাটনে তদন্তে নামে পুলিশের চৌকস টিম পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
অবশেষে ১০ মাস আগে সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা।
রবিবার (৮ আগস্ট) হত্যা মামলার প্রধান আসামি আশরাফুল হক প্রকাশ সাব্বির (২৩) ও তার মা শিউলী বেগমকে (৪৫) আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম। আর তাদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে পরকীয়ার প্রেম ও হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর কাহিনী।
রবিবার রাতে গণমাধ্যমকে তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান।
তিনি জানান, মায়ের সঙ্গে পরকীয়ার কারণে প্রেমিক নবী হোসেন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে ছেলে আশরাফুল হক প্রকাশ সাব্বির ও তার ভাড়াটে খুনিরা। নিহত নবী হোসেন (৩০) ভৈরব উপজেলার আগানগর গ্রামে মো. ইসমাইলের ছেলে।
পড়ুন: বিয়ের ৮ মাসের মাথায় গৃহবধূকে ‘হত্যার’ অভিযোগ
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চট্টগ্রাম পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক মো. মনির হোসেন জানান, মোবাইলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে শনিবার রাতে আশুগঞ্জের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মা-ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছি। গত বছর ১৬ অক্টোবর খুনের ঘটনাটি ঘটে। এরপর থেকে তারা পলাতক ছিলেন।
তিনি জানান, শিউলী বেগমের স্বামী আনোয়ার হোসেন সৌদি আরব থাকায় স্বামীর বন্ধু নবী হোসেনের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এরই মধ্য ওই নারী তার স্বামীকে তালাক দিয়ে নবী হোসেনকে বিয়ে করেন। মায়ের অসম প্রেম ও দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনাটি সহ্য করতে পারেননি তার ছেলে সাব্বির। তাই পরিকল্পনা করে মায়ের দ্বিতীয় স্বামী নবী হোসেনকে হত্যা করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছরের ১৫ অক্টোবর ভাড়াটে খুনি দিয়ে নবী হোসেনকে অপহরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরদিন ১৬ অক্টোবর কৌশলে সাব্বির নবী হোসেনকে দাওয়াতের কথা বলে একটি প্রাইভেটকারে তুলে কুমিল্লায় নিয়ে চলন্ত গাড়িতে তাকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। এ সময় গাড়িতে সাব্বিরের তিন ভাড়া করা খুনি তুষার, সুমন আশিক হত্যায় অংশ নেয়। তারপর নবী হোসের লাশ চট্টগ্রামে চলে আসে তারা। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাবার পথে মহাসড়কের পটিয়ার মনসা আইডিয়াল স্কুলের পূর্ব-উত্তর পাশে ব্রীজের নীচে নবীর লাশ ফেলে দিয়ে কানিয়ে তারা কক্সবাজার চলে যায়।
পিবিআই’র এ কর্মকর্তা আরও জানান, খুনিরা কক্সবাজার থেকে ভৈরব ফেরত যাওয়ার পর হত্যার পরিকল্পনাকারী সাব্বির গাড়ি ভাড়া বাবদ ১৫ হাজার খুনের জন্য পূর্বের চুক্তি মোতাবেক ৬০ হাজার টাকা আসামি তুষারকে পরিশোধ করে। তুষার সে টাকা থেকে সুমনকে ১৭ হাজার এবং আশিককে ১৮ হাজার টাকা প্রদান করে এবং তুষার নিজে ২৫ টাকা রাখে।
এদিকে পটিয়া থানার পুলিশ পরদিন জঙ্গল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পকেটে থাকা আইডি কার্ড পেয়ে নিহতের পরিবারকে ভৈরব থানার মাধ্যমে খবর দেয়। খবর পেয়ে তার ভাই কবির হোসেন চট্টগ্রাম গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। এরপর কবির হোসেন বাদী হয়ে পটিয়া থানায় ৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করে। মামলাটি তদন্ত করতে চট্টগ্রামের পিবিআইকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে হত্যা মামলার আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত
সাক্ষ্যপ্রমাণই বলে দেয় জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন: তথ্যমন্ত্রী
পিবিআই মামলাটি তদন্ত নেয়ার পর এর আগে প্রাইভেটকারের চালক আশিক ও সহকারী সুমনকে ভৈরবের দুটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তারা দুজন চট্টগ্রাম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হত্যার ঘটনাটি স্বীকার করেন।
আদালতে তারা কীভাবে নবী হোসেনকে গাড়ির ভিতর হত্যা করে পটিয়ার জঙ্গলে ফেলে পালিয়ে আসে সেই বর্ণনা দেন। এভাবেই নবী হোসেনের খুনের ঘটনাটি উদঘাটন হয়।
মামলার বাদী নিহত নবী হোসেনের ছোটভাই কবির হোসেন বলেন, আমার ভাইকে নির্মমভাবে শ্বাসরুদ্ধ করে খুনিরা হত্যা করে। শনিবার গভীর রাতে পিবিআই পুলিশ প্রধান খুনি সাব্বিরসহ তার মাকে গ্রেপ্তার করেছে শুনেছি। আমি আমার ভাইয়ের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
পিবিআই জানায়, মা ছেলে গ্রেপ্তারের পর রবিবার বিকালে চট্টগ্রামে এনে আদালতে হাজির করলে আদালতে তারা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।