অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা গেলে ভবিষ্যতে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এছাড়া, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য যে খাতগুলো থেকে সবচেয় বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর জন্য উপযুক্ত প্রতিটি শিল্প দ্রুত চিহ্নিত করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
আজ বৃহস্পতিবার মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর ৪১তম অর্থাৎ শেষ স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো।
সেতুটির নির্মাণ কাজ ২০১৪ সালের নভেম্বরে শুরু হয় এবং যানবাহন চলাচল বা জনসাধারণের এটি ২০২২ সালে উন্মুক্ত করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলাকে সরাসরি সংযুক্ত করবে রাজধানীর সাথে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ইউএনবিকে বলেন, পদ্মা সেতু অবশ্যই দেশের জন্য একটি অর্জন কারণ এটি দেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনা আছেন বলেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান: মন্ত্রী
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এ সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার শেষ বাধা অতিক্রম করবে এবং একীভূত দেশে পরিণত হবে। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য এক বড় অর্জন। এ সেতুর সড়ক ও রেল লাইনের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। উৎপাদক এবং ভোক্তাদের জন্য পণ্যের ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত হবে।’
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর আরও জানান, সেতুটি দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়াও এর মাধ্যমে ভারত, নেপাল এবং ভুটানের সাথে একটি সংযোগ তৈরি হতে পারে।
‘পদ্মা সেতুর সুবিধা পাওয়ার জন্য এখন আমাদের যথাযথ কৌশল গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি এর সুবিধাগুলো কাজে না লাগাতে পারি তাহলে কেবল সেতু তৈরি করে কোনো লাভ নেই। আমাদের এখন সেখানে অর্থনীতি-ভিত্তিক শিল্পের ওপর জোর দিতে হবে। শিগগিরই এ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে,’ বলেন তিনি।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে কর্মসংস্থানের একটি চাহিদা সৃষ্টি হবে। সেই চাহিদা মেটাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে সরকারের জোর দেয়া উচিত।
‘এখন জেলাগুলোতে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সেবা দেয়ার বিষয়টি সরকারকে চিন্তা করতে হবে, যেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে,’ বলেন তিনি।
আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু নির্মাণ সকল ষড়যন্ত্রের জবাব: প্রতিমন্ত্রী
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামো বিবেচনায় পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৩ শতাংশ বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করবে। তবে, অঞ্চলগুলোতে এখনই সঠিক কৌশল গ্রহণ করা গেলে এ প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।’
ইউএনবির সাথে আলাপকালে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ জানান, সেতুটি নির্মাণকালে ইতোমধ্যে কিছু অস্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। তবে একটি বড় অঞ্চল হওয়ায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এখন যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের সময় এসেছে।
তিনি বলেন, ‘দ্রুত সুবিধা পেতে চাইলে, সঠিক পরিকল্পনাও আমাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে নিতে হবে। বেসরকারি অংশীদারদের সাথে নিয়ে সরকারকে জেলাগুলোতে কৃষি-ভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পের ওপর জোর দেয়া উচিত। শিল্পগুলোর জন্য সঠিক স্থান চিহ্নিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।’
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ক্ষুদ্র ব্যবসাকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সরকারের উচিত ছোট ব্যবসা থেকেও পণ্য ক্রয় করা।
ড. মাসরুর বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক সুবিধা কী কী সরকারকে তা এখন খুঁজে বের করতে হবে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে দেশের সব অঞ্চলের মধ্যেই একটি দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে।
‘এখন অঞ্চলগুলোতে রপ্তানিমুখী কৃষি-ভিত্তিক পণ্যগুলোর জন্য জোন চিহ্নিত করা যেতে পারে। দেশে কৃষিপণ্যের জন্য উপযুক্ত কোল্ড স্টোরেজ হাউস নেই। তাই কৃষিপণ্যের বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে উপযুক্ত স্থান বেছে নেয়াসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত,’ বলেন তিনি।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত যথাযথভাবে বাজার বিশ্লেষণ এবং ব্যবধানগুলো দূর করা। সঠিক পরিকল্পনা ও কৌশল না থাকায় যমুনা সেতু নির্মাণের পরেও দেশের উত্তরাঞ্চল শিল্পায়িত হতে পারেনি।
‘সুতরাং, এখন পদ্মা সেতু সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য দেশের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে,’ পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদ মাসরুর রিয়াজ।
আরও পড়ুন: স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান
পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, ‘গত ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেতুর মূল নির্মাণ কাজ ৯১ শতাংশ এবং প্রকল্পের সামগ্রিক নির্মাণ কাজ ৮২.৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০২২ সালে।’
শফিকুল বলেন, পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্পের সারসংক্ষেপ
মূল পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের (এমবিইসি) সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় সরকার। পদ্মা সেতুর প্রস্থ হবে ৭২ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এ সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার এবং দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) সংযোগ সড়ক ১৪ কিলোমিটার। পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটি ২০০৭ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেয়, যার আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। তবে পরবর্তীতে সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়েক দফায় ব্যয় সংশোধনের পর সর্বশেষ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।