বিশ্বে ঘটা করে যখন পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। তখন দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে ৩২টি বছর ধরে রাস্তা-ঘাট, দোকান, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বারান্দা ও শহীদ মিনারের ময়লা-আবর্জনা পরিস্কার করে চলেছেন মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী।
এতদিনেও তার পরিচয় বা ঠিকানা জানতে পারেননি কেউ। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী এই বৃদ্ধ নারীর নাম দিয়েছেন আমেনা। সবাই তাকে আমেনা নামেই চেনেন-জানেন। অন্যের দেয়া খাবার খেয়ে জীবন নির্বাহ করেন তিনি। এখন বয়সের ভাড়ে ন্যুয়েপড়া এই নারী কোনো দোকান কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় শীত, গরম আর বৃষ্টিতে পার করছেন দিনরাত। কিন্তু আজও তার ভাগ্যে জুটেনি মাথা গোঁজার ঠাই। মেলেনি অন্য কোন সুযোগ-সুবিধা। পাননি পরিবারের খোঁজ।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কর্মসূচি বিস্তারিত জানালেন প্রতিমন্ত্রী
কবি লিখেছেন ধু-ধু জ্বলে উঠো ধূমায়িত অগ্নি/ জাগো মাতা, কন্যা, বধূ জায়া ভগ্নি এই কবিতায় নারীরা তাদের চিন্তা, চেতনায়, কর্মে, মননে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে জেগে উঠবে- কবি হয়ত সেটাই বুঝাতে চেয়েছেন। হয়ত কেউ পেরেছেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, কেউ বা অন্যের সহযোগিতা না পেয়ে হেরে গেছেন নিজের কাছে। তাদের এমনই একজন আমেনা পাগলি। অনেকে তাকে আমেনা পাগলি নামেও ডাকেন।
নবাবগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৯০-৯১ সালের কথা। শহরের ফুটপাত, রাস্তা, দোকান-পাটের সামনে মাঝবয়সী অপরিচিত এক নারীকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। সে কারও কাছে ভিক্ষা চায় না। যদি কেউ ইচ্ছা করে কিছু দেয় সেটি গ্রহণ করে। না দিলে চায় না। সে শহরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে। হঠাৎ একদিন আমরা দেখি কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই নারী শহরের ফুটপাত, রাস্তা, দোকানের সামনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বারান্দা, শহীদ মিনার, উপজেলা পরিষদের চত্বরে জমে থাকা ধূলা, ময়লা, আবর্জনার স্তুপ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করছে।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সে পরিচ্ছন্নতা কর্মী না। কিন্তু বিনা পয়সায় এই কাজ করছে। তার এই কাজ দেখে আমাদের মধ্যে কৌতূহল জাগে। আমরা তার নাম, ঠিকানা জানতে চাইলে সে কোনো কথাও বলে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তখন আমরা তার নাম দেই আমেনা। সে এখন সবার কাছে প্রিয়মুখ হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় দোকানদার আব্দুল খালেক ও ফরিদুল ইসলাম জানান, সে দোকানের বারান্দা ঝাড়ু দেয়ার পাশপাশি কাঁদা দিয়ে লেপে দেয়। নিষেধ করলে শুনে না। বরং সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। দীর্ঘ ৩২টি বছর এভাবে কোলাহলমুক্ত ছোট্ট শহরের মানুষের হৃদয়ে সে ঠাই করে নিয়েছে। যা কিছু করে তা আপন খেয়ালেই করে। তার একটি পছন্দের কুকুর আছে। আমেনা তিন বেলা খেলে তার কুকুরকে তিনবেলা খেতে দেয়। পাশাপাশি একসঙ্গে ঘুমায়ও।
নবাবগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিক সুলতান মাহমুদ জানান, আমেনার থাকার কোন ঘর নেই। রোদ- বৃষ্টি, শীত কি? যখন মনে চায় কোন এক দোকানের বারান্দা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় সে রাত কাটায়। আমেনা দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে এখানে বসবাস করছে। সে কথা বলতে পারে না। সে কি যেন মনে মনে বলে। কিন্তু সেই কথা বা ভাষা বোঝা যায় না। আমরা তার পরিবারের কোন খোঁজ পায়নি।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ
নবাবগঞ্জ কেন্দ্রীয় ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম জানান, আমেনাকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে একটি ঘর সহ সরকারের সুবিধাগুলো দেয়া দরকার। তাহলে হয়ত আমেনা শেষ বয়সে হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। যে নারী তার সারাজীবনে অন্যের ভালো করছে, সেই নারীর শেষ জীবনে কোথায় ঠাঁই হবে। শেষ জীবনে কে নিবে তার দায়িত্ব? এজন্য কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে।
নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার এম এম আশিক রেজা জানান, আমেনার বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। সে সরকারের সুবিধা যেন পায় সেটা ভেবে দেখছি।
নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, তাকে আমরা একটি ঘর করে দিব। সে ওই ঘরে থাকবে কিনা বলতে পারব না। কারণ সে দোকান বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় থাকতে পছন্দ করে। তারপরেও আমেনার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এদিকে সরকার নারী উদ্যোক্তা তৈরি এবং নারীর ক্ষমতায়নে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু পিছিয়ে পড়া এই নারীদের ব্যাপারে উদ্যোগ নিবে সরকার এই প্রত্যাশা করছেন অনেকে।
আরও পড়ুন: ইউএনবিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন