ইউক্রেনের যুদ্ধ, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যসহ বহু প্রতিযোগিতামূলক সংকটের মধ্যে মিশরের শারম এল শাইখে ৬-১৮ নভেম্বর চলছে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার শেষ সুযোগ হিসাবে বিবেচিত জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু আলোচনা।
বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু অর্থায়ন হলো জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের ২৭তম সম্মেলনে আলোচনা করা প্রধান বিষয়গুলির মধ্যে একটি।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল বলেছে, তারা উন্নত দেশগুলিকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থ প্রদানের জন্য বোঝানোর চেষ্টা করবে যা তারা আগে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের সদস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক ইউএনবিকে জানান, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ২০১৫ সালে। এরপর ওই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গাইডলাইন বা রুলবুক প্রণয়নের কাজ চলছিল এত বছর ধরে। সেটিও সম্পন্ন হয়ে অনুমোদন হয়ে গেছে গত বছরের গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে। পাশাপাশি প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আলোকে গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। এরমধ্যে অন্যতম ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা, মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কমানো এবং বন উজাড় বন্ধ করা।
এছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে ২০৩০ সালের কার্বন নিঃসরণ ২০১০ সালের চেয়ে ৪৫ শতাংশ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু গত এক বছরে সেই সব প্রতিশ্রুতির ধারেকাছেও কোন দেশ বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো এখনও যায়নি।
আরও পড়ুন: বহুবিষয়ে অগ্রগতি নেই, তবে কপ২৭ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের যোগদান আশাপ্রদ: তথ্যমন্ত্রী
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ইউএনবিকে বলেন, উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি দেয়া শুরু হয়েছিল সেই ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলন থেকে। এরপর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে একের পর এক প্রতিশ্রুতি এসেছে। আবার এসব প্রতিশ্রুতি আদায় করতেও বাংলাদেশে মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এতে জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সমঝোতাকারীদের অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আরও বলছেন, ২০০৯ সালেই উন্নত দেশগুলো কোপেনহেগেন অ্যাকর্ডে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার করে দিবে। ২০২০ সাল গিয়ে ২০২২ সালও চলে যাচ্ছে। এখন সময়ের পরিবর্তনে ১০০ বিলিয়ন ডলারের চাহিদা ৫০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মূল প্রতিশ্রুতিই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে ২০১০ সাল থেকে ফাস্ট ট্র্যাক ফাইন্যান্স হিসেবে উন্নত দেশগুলো তিন বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রতিও তারা ( উন্নত দেশগুলো ) বাস্তবায়ন করেনি। উল্টো পুরনো দেয়া ঋণ ও অনুদানকে গোজামিল দিয়ে হিসাব দিয়েছিল ২০১৩ সালে জলবায়ু সম্মেলনে।
এ প্রসঙ্গে সম্মেলন পর্যবেক্ষণকারী জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মো. সামছুদ্দোহা ইউএনবিকে বলেন, সেই কোপেনহেগেন অ্যাকর্ডে উন্নত দেশগুলোর চাপে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ওই সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কোর কমিটির মাধ্যমে গুরত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের দাবি ছিল ২ ডিগ্রি নয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। বাংলাদেশের সেই দাবিও কোপেনহেগেন অ্যাকর্ডে ঠায় পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বেডে যাওয়ায় বিশ্ব জোরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বেড়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে জোরালো দাবি উঠে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি নয়, ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা আন্তঃসরকার প্যানেল আইপিসিসি তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে জানায়, জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে ঘটছে তাতে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যেই রাখতে হবে। জাতিসংঘ তাতে মত দেয়। শেষ পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো তাদের ২ ডিগ্রি দাবি থেকে সরে আসে। ফলে প্যারিস চুক্তিতে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত মানছে না উন্নত দেশগুলো। তাদের কারণে বর্তমানে যে হারে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে তাতে এই শতাব্দী শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি পৌঁছাবে। এই তথ্য খোদ জাতিসংঘ বিভিন্ন সংস্থার।
তিনি আরও বলেন, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তাই এবারের জলবায়ু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা নতুন প্রতিশ্রুতি বাদ দিয়ে পুরনো ‘প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে’ উদ্যোগী হয়েছেন। তাই এবারের জলবায়ু সম্মেলনেকে প্রতিশ্রুতি বাস্তবাস্তবায়ের সম্মেলন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সম্মেলনের শুরু থেকে নতুন দরকষাকষিতে না গিয়ে আগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে জোর দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে মিশর প্রেসিডেন্সির সঙ্গে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। সম্মেলনে ১০০টি দেশের বেশি শীর্ষ নেতারা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। সকলেই একবাক্যে তাদের দেয়া বক্তব্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করার তাগিদ দিয়েছেন।
ইতোমধ্যে সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অনুসঙ্গ হিসেবে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে দুর্যোগের আগাম সতর্কতা ব্যবস্হা জোরদার করা। কারণ বিদ্যমান প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসে এই আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা কার্যক্রম উদ্ভোধন করেছেন। একইসঙ্গে তিনি আরও উদ্ভোধন করেছেন, বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের জন্য গ্রিন হাউজ গ্যাস ইনভেন্টরি কার্যক্রম। এর মাধ্যমে বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের প্রকৃতপক্ষে তথ্য জানা যাবে।
বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার দেয়া কার্বন নিঃসরণ তথ্যের সঙ্গে প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে অর্থায়ন ও অভিযোজনের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য কার্বন নিঃসরণের প্রকৃত তথ্য জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত দেশগুলোই দায়ী: তথ্যমন্ত্রী
রুশ রাষ্ট্রদূত আশা করছেন শিগগিরই ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ হবে: তথ্যমন্ত্রী