বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ আদেশে বলেছে, ‘‘কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ কোনো রোগীকে চিকিৎসা সেবা প্রদানে অনিহা দেখালে এবং এতে ওই রোগীর মৃত্যু ঘটলে ‘তা হবে অবহেলাজনিত মৃত্যু’ অর্থাৎ ‘ফৌজদারি অপরাধ’।’’
আদালত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যাতে কোভিড ও নন-কোভিড সকল রোগীকে পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা দেয়া হয় সে বিষয়টি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে একটি মনিটরিং সেল গঠনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে।
করোনা মহামারির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাধারণ রোগীসহ আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা নিয়ে দায়ের করা পৃথক পাঁচটি রিটের শুনানি নিয়ে ওই নির্দেশনা ও অভিমত দিয়ে আদেশ দেয় আদালত।
আদেশের কপি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব, স্বাস্থ্যসচিব (স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ), বাণিজ্যসচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে গত ১১ মে এবং গত ২৪ মে জারি করা নির্দেশনাসমূহ বিবেচনায় নিয়ে এসব আদেশ দেন।
আদালত ১১ দফা আদেশ ও অভিমত দেন। সেগুলো হলো-
১১ মে এবং গত ২৪ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওইসব নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কি-না এবিষয়ে একটি প্রতিবেদন আগামী ৩০ জুনের মধ্যে অত্র আদালতে দাখিলের জন্য স্বাস্থ্যসচিব (স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়েছে।
সরকারি নির্দেশনাসমূহ পালনে ব্যর্থ ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি-না তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে বলেছে আদালত।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ২৪ মে জারি করা নির্দেশনা অনুসারে ওই তারিখের পর ৫০ শয্যার অধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক সমূহে ১৫ জুন পর্যন্ত কতজন কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে তা উল্লেখিত তারিখের মধ্যে জমা দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে। তৎসঙ্গে ৫০ শয্যার অধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক সমূহের একটি তালিকা প্রেরণ করতে হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনাসমূহ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালন করছে কি-না সে বিষয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের কর্তৃপক্ষকে ১৫দিন পরপর একটি প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওই সকল প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৫দিন পরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে।
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক সমূহের বিশেষত ঢাকা মহানগর ও জেলা, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলাসহ বিভাগীয় শহরের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ যাতে কোভিড ও নন-কোভিড সকল রোগীকে পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা প্রদান করে, সে বিষয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ কোনো রোগীকে চিকিৎসা সেবা প্রদানে অনিহা দেখালে এবং এতে করে ওই রোগীর মৃত্যু ঘটলে ‘তা অবহেলাজনিত মৃত্যু’ হিসেবে বিবেচিত অর্থাৎ ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে বিবেচিত হবে। দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার প্রদত্ত নির্দেশনা যথাযথভাবে দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে অধিকতর জবাবদিহিমূলক ও বিস্তৃত করতে হবে। ভুক্তভোগীরা যাতে এ সেবা দ্রুত ও সহজভাবে পেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোন হাসপাতালে আইসিইউতে কত জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং কতটি আইসিইউ শয্যা কী অবস্থায় আছে, তার আপডেট প্রতিদিনের প্রচারিত স্বাস্থ্য বুলেটিন এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। আইসিইউ ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং সেলে ভুক্তভোগীরা যাতে সহজেই যোগাযোগ করতে পারে সেজন্য পৃথকভাবে ‘আইসিইউ হটলাইন’ নামে পৃথক হটলাইন চালু এবং হটলাইন নম্বর গুলো প্রতিদিন বিভিন্ন গনমাধ্যমে বিশেষত টেলিভিশন মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন কোভিড-১৯ রোগী চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ মাত্রাতিরিক্ত বা অযৌক্তিক ফি আদায় না করতে পারে সে বিষয়ে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
অক্সিজেন সিলিন্ডারের খুচরা মূল্য এবং রিফিলিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে। খুচরা বিক্রেতাদের সিলিন্ডারের নির্ধারিত মূল্য প্রতিষ্ঠান/দোকানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃত্রিম সংকট রোধে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র এবং রোগীর পরিচয়পত্র ব্যতীত অক্সিজেন সিলিন্ডারের খুচরা বিক্রয় বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারে। অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ ও বিক্রয় ব্যবস্থা মনিটরিং জোরদার করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে।
সরকার এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে বিভক্ত করে পর্যায়ক্রমে লকডাউনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এমতাবস্থায় বর্তমান পর্যায়ে লকডাউনের বিষয়ে কোনো আদেশ দেয়া সংগত হবে না মর্মে আদালত মনে করে।
দেশে বিদ্যমান সামগ্রিক পরিস্থিতি অর্থাৎ বর্তমানে দেশে বিরাজমান করোনা পরিস্থিতি একটি ‘দুর্যোগ’ বিবেচনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গৃহীত কার্যক্রমের পাশাপাশি সরকার ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-২০১২ এর ধারা-১৪ অনুসারে ‘ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অরডিনেশন গ্রুপ’র কার্যক্রমকে সক্রিয় করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারে। ওই কমিটি কার্যকর হলে কমিটির সুপারিশের আলোকে উপরোক্ত আইনের ধারা-২৬ অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক রিকুইজিশান করা যেতে পারে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতালের ‘আইসিইউ বেড অধিগ্রহণ’ ও অনলাইনে ‘সেন্ট্রাল বেড ব্যুরো’ গঠনের নির্দেশনা চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডেপুটি রেজিস্ট্রার শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন ৬ জুন হাইকোর্টে একটি রিট করেন। আদালতে এই রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ইয়াদিয়া জামান। ঢাকা শহরকে লকডাউন ঘোষণা ও চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত হাই ফ্রো-নেজাল অক্সিজেন ক্যানোলা সংগ্রহের নির্দেশনা চেয়ে ১১ জুন আইনজীবী মো. মাহবুবুল ইসলাম অপর রিটটি করেন। এই রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
এর আগে সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সাধারণ রোগীদের (নন–কোভিড) ফিরিয়ে দেওয়ার বৈধতা নিয়ে ১০ জুন আরেকটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের চার আইনজীবী। তাঁরা হলেন, আইনজীবী এ এম জামিউল হক, মো. নাজমুল হুদা, মোহাম্মদ মেহেদী হাসান ও এ কে এম এহসানুর রহমান। এই রিটের পক্ষে আবেদনকারীরা নিজে শুনানিতে অংশ নেন।
আর করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় সরকারি নির্দেশনার বাইরে অতিরিক্ত অর্থ না নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে ১০ জুন অপর রিটটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। এই রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী অনীক আর হক। এ ছাড়া মহামারি করোনাভাইরাসের সময় হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের নির্দেশনা চেয়ে একই দিন জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের পক্ষে সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলন আরেকটি রিট করেন। এ রিটের পক্ষের নিজেই শুনানি করেন। পৃথক পাঁচটি রিটের ওপর একসঙ্গে ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতিতে শুনানি নিয়ে অভিমতসহ নির্দেশনা দিয়ে আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যার্টনি জেনারেল মুরাদ রেজা ও ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল অমিত তালুকদার, সঙ্গে ছিলেন সহাকারী অ্যার্টনি জেনারেল অবন্তী নূরুল।