ইউনিসেফ, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স (গ্যাভি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার জরায়ুমুখ ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচপিভি) এর প্রতিষেধক টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে।
এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো, দেশের লাখ লাখ মেয়ে ও নারীদেরকে জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যত সুরক্ষিত করা। প্রতি বছর হাজার হাজার নারীর জীবন কেড়ে নেয় এই জরায়ুমুখ ক্যান্সার।
এই টিকাদন কার্যক্রম প্রথমে ঢাকা বিভাগে শুরু হবে। পরে পর্যায়ক্রমে তিন ধাপে বাংলাদেশের মোট আটটি বিভাগে বাস্তবায়ন করা হবে।
এই কর্মসূচির আওতায় পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রী এবং স্কুলে পড়ে না এমন ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুসহ প্রায় এক কোটিরও বেশি মেয়েদের বিনামূল্যে এই এইচপিভি টিকা প্রদান করা হবে।
প্রথম পর্যায়ে, মোট ১৮দিন এই টিকাদান কর্মসূচি চলবে। টিকা গ্রহণে উপযুক্ত মেয়েরা ভ্যাক্সেপি অ্যাপ অথবা ওয়েবসাইটে নিবন্ধনের মাধ্যমে ঢাকায় তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা মনোনীত টিকাদান কেন্দ্রে এইচপিভি টিকা নিতে পারবে। ২০২৪ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে দেশের অন্য বিভাগের মেয়েদের এই টিকা দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার দেশের সকল জনসাধারণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকল্পে বদ্ধ পরিকর। ইতোমধ্যেই সরকার টিকা দ্বারা প্রতিরোধযোগ্য রোগের বিরুদ্ধে টিকা প্রদানের মাধ্যমে মা ও শিশু মৃত্যু এবং পঙ্গুত্ব রোধে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। বৈশ্বিক কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবিলাতেও বাংলাদেশ সারাবিশ্বে নিজেকে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।’
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে কলেরা টিকাদান কার্যক্রম শুরু ১৭ সেপ্টেম্বর
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে টিকাদান কার্যক্রমের অসামান্য সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে গ্যাভি কর্তৃক ভ্যাকসিন হিরো সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ ইপিআই কার্যক্রমের ইতিহাসে একটি মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা উপনীত হয়েছি, কারণ আজ আমরা জরায়ুমুখ ক্যান্সারের মত একটি প্রাণঘাতী রোগের বিরুদ্ধে ১ ডোজ এইচপিভি টিকা প্রদানের মাধ্যমে দেশকে জরায়ুমুখ ক্যান্সারমুক্ত করার মহৎ যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি।’
গ্যাভির সহায়তায় ইউনিসেফ ঢাকা বিভাগের মেয়েদের জন্য ২৩ লাখ এইচপিভি টিাকা সরবরাহ করেছে। সরকার প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছাতে এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও এইচপিভি টিকা গ্রহণের উপযুক্ত পথ শিশুদের এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।
দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভির কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডেলিভারি ম্যানেজিং ডিরেক্টর থাবানি মাফোসা বলেন, ‘জীবন রক্ষাকারী এইচপিভি টিকা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে বাংলাদেশের কিশোরীদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অভিনন্দন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাপক পরিসরে এই কর্মসূচির বাস্তবায়ন বাংলাদেশে সব মেয়ের সুস্বাস্থ্য ও বিকাশ নিশ্চিত করতে এবং দেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে দারুণ সহায়ক হবে। জীবন রক্ষায় সাহায্যকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই টিকা তৈরিতে সহযোগিতা করতে পেরে গ্যাভি গর্বিত।’
জরায়ুমুখ ক্যান্সার হয় হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) থেকে। আর এইচপিভি টিকার মাত্র একটি ডোজই জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ‘এটি দুঃখজনক যে বাংলাদেশে প্রতি বছর জরায়ুমুখ ক্যান্সারে বিপুল সংখ্যক নারীর মৃত্যু হয়। অথচ অল্প বয়সে মেয়েদের মাত্র এক ডোজ টিকা দিয়ে এই মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। এইচপিভি টিকা প্রদানে সরকারকে সহায়তা করতে পেরে আমরা আনন্দিত। এই টিকার মাধ্যমে দেশের কয়েক লক্ষ মেয়ে জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাবে, নিশ্চিত হবে কিশোরী মেয়েদের ভবিষ্যৎ।’
আরও পড়ুন: বিশ্ব টিকাদান সপ্তাহ: টিকাদান নিশ্চিত করতে দেশগুলোকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার
এই টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং শিক্ষক, বাবা-মা ও ধর্মীয় নেতাদের এ বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা প্রদান করা হয়েছে, যাতে কোনো মেয়ে এই টিকাদান কর্মসূচি থেকে বাদ না পড়ে।
বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ডা. বারদান জাং রানা বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার বিবেচনায় জরায়ুমুখ ক্যান্সার-এর অবস্থান দ্বিতীয়; দেশে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় এই জরায়ুমুখ ক্যান্সারের মাধ্যমে।’
তিনি বলেন, ‘অনুমান করা হয় যে বাংলাদেশে প্রতি বছর জরায়ুমুখ ক্যান্সারে প্রায় ৮ হাজার ৩০০টি নতুন কেস ধরা পড়ে এবং এই রোগে ৪ হাজার ৯০০ জন মারা যায়। আমরা এই পরিসংখ্যান পরিবর্তন করতে পারি যদি এখনই পদক্ষেপ নেই এবং নিশ্চিত করি যে, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতিটি মেয়ে এইচপিভি টিকার একটি করে ডোজ পাবে। এইচপিভি টিকা জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর টিকাগুলোর একটি।’
তিনি আরও বলেন, ‘টিকা গ্রহণে উপযুক্ত মেয়েদের জন্য ঢাকা বিভাগে এই টিকাদান কার্যক্রম শুরু করায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানায়। এই উদ্যোগ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় ক্ষেত্রে আমাদের নারীদের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ এই টিকা প্রদানে সহযোগিতা করতে পেরে গর্ববোধ করে। পাশাপাশি এইচপিভি টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে উপযুক্ত কিশোরীদের সহায়তা করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করে।’
তিনটি পর্যায় শেষ হলে এইচপিভি টিকা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া এবং লেখপড়ার বাইরে থাকা ১০ বছর বয়সী মেয়েদের জন্য নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হবে। তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যকর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণে বাংলাদেশ সরকার যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই টিকাদান কর্মসূচি।
আরও পড়ুন: ১ ডিসেম্বর থেকে ৭ দিনব্যাপী করোনার টিকাদান কর্মসূচি