আজ নুসরাত হত্যার তৃতীয় বাষির্কী। ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অগ্নিদগ্ধ মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল বিকালে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে সোনাগাজী মোহাম্মদ ছাবের সরকারি মডেল পাইলট হাইস্কুল মাঠে নামাজে জানাজা শেষে তাকে সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
শনিবার বিকেলে নুসরাতের মৃত্যুবাষির্কীতে সামাজিক হামিদিয়া মসজিদে মিলাত, দোয়া ও ইফতারের মাধ্যমে পারিবারিকভাবে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়েছে বলে জানান নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।
রবিবার নুসরাত পরিবারের সঙ্গে ইফতার করবেন পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। প্রতিবারের মতো এবারও উত্তর চর ছান্দিয়া গ্রামে নুসরাতের কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবে ফেনীর পিবিআই।
আরও পড়ুন: নুসরাত হত্যা: ওসি মোয়াজ্জেমের জামিন শুনানি ৩ মাস মুলতবি
নোমান বলেন, নুসরাত হত্যাকাণ্ডের তিন বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে বিষেদাগার করে অপপ্রচার করছে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আত্মীয় স্বজনরা। যার কারণে আমরা সামাজিক মান সম্মানের ভয়ে আতংকিত থাকি। এ ব্যাপারে আমরা আইসিটি আইনে মামলা করেছি, যা পিবিআইতে তদন্তাধীন রয়েছে।
নুসরাত জানান রাফির মা শিরিন আক্তার বলেন, তিনটি বছর পার হলেও আজও নুসরাতের স্মৃতিরক্ষায় তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। নিজের জীবন দিয়ে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করলেও পাননি সরকারি-বেসরকারি কোন সম্মান। আফসোস করে তিনি বলেন, প্রতিবছর এইদিনে পুলিশ ও সাংবাদিকরা এসে খোজঁখবর নেন, তারপর আর কোন খবর থাকে না। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তার বাস্তবায়ন হয়নি। নুসরাতের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি সড়ক, স্কুল বা মাদরাসার নাম করণের দাবি জানান তিনি।
আরও পড়ুন: ছয় বছরেও তনু হত্যা মামলার অগ্রগতি নেই
নুসরাতের মা শিরিন আক্তারের কাছে তার প্রিয় কন্যা নুসরাত রাফির শূন্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজও প্রতিদিন ভোরে তাকে খুঁজি। মনে হয় এই বুঝি নুসরাত এসে জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাকছে। তার স্মৃতি আজও ঘরের, বাড়ির সবকিছুতেই রয়েছে। তার পড়ার বই, জামা কাপড় ও পছন্দের সবকিছুই গোঁছানোভাবে রাখা হয়েছে ঘরের মধ্যে। আজ তিন বছর আমি আমার মেয়ের কণ্ঠে মা ডাকটি শুনতে পাই না। রাতে ঘুম হয় না। কারণ আমার মেয়ের হাত-পা বেঁধে যখন তারা আগুন লাগিয়েছিল, তখন আমার মেয়ে কি করেছিল? সেদিন আমি খবর পেয়ে ফেনী সদর হাসপাতালে ছুটে যাই, তখন পুলিশ সদস্যরা আমার মেয়ের কাছে ভিড়তে দেয় নাই। তার পুরো শরীর ব্যান্ডেজ করে ফেলে ডাক্তাররা। পুলিশরা আমাকে বলে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। বাঁচে কিনা সন্দেহ? আপনি মেয়ের আগুনে পোড়া এই শরীর দেখলে সহ্য করতে পারবেন না। ডাক্তাররা আপনাকে দূরে থাকতে বলেছে। তখন আমার মেয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল।
দেশে করোনাভাইরাসে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা মনেরে বুঝ দিতে পারবে, করোনাভাইরাসে তারা মারা যাচ্ছে। কিন্তু আমার মেয়েকে জানোয়ারেরা হাত-পা বেঁধে আগুন দিয়ে পুড়ে মেরেছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের ৯৯ ভাগ মানুষ আমার মেয়ের পাশে ছিল। আমাদের পরিবারের পাশে ছিল। আসামি ও তাদের স্বজনরাসহ এক পার্সেন্ট মানুষ আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে থাকতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। শুনেছি উচ্চ আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল করেছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসামিদের রায় দ্রুত কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
বাদীপক্ষের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু বলেন, ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে তা অনুমোদনের জন্য উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে বেঞ্চ করোনার কারণে বাতিল হয়ে গেছে। এরপর বেঞ্চ গঠন হয়নি। তাই মামলাটির শুনানি হচ্ছে না।
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় পরীক্ষা দিতে গিয়ে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল মাদরাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে নিয়ে তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। চারদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।
২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ মামলার রায়ে ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়। আসামিরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), নূর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।