তিনি বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কের পূর্বাভাসকে মাত্র তিনটি শব্দে সংক্ষেপিত করেন- বিকাশের সম্ভাবনা, বাস্তবসম্মত ও জনবান্ধব (উদ্যোগ)।
বাংলাদেশের সাথে নিজেদের সম্পর্ককে ‘বহুমুখী, গভীর ও ঐতিহাসিক’ হিসেবে বর্ণনা করে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাবে।’
রাজধানীর সিক্স সিজন হোটেলে কসমস ডায়ালগের অ্যাম্বাসেডর লেকচার সিরিজের আওতায় ‘বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক: ভবিষ্যতের জন্য পূর্বাভাস’ শীর্ষক সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কসমস গ্রুপের জনহিতকর সংস্থা কসমস ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের (আইএসএএস) প্রিন্সিপাল রিসার্চ ফেলো ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।
সংলাপে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান।
ইউএনবি চেয়ারম্যান আমানুল্লাহ খান, অর্থনীতিবিদ ড. জাইদী সাত্তার, বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন, কানাডার হাইকমিশনার বেনোইট প্রিফোনতাইনে, ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জোয়াও তাবাজারা ডি অলিভিয়েরা জুনিয়র, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী ও মো. তৌহিদ হোসেন, বিশিষ্ট নেতা সালাউদ্দিন কাশেম খান এবং সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিকরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশসহ সব দেশকে সাথে নিয়ে সামনের দশকের দিকে এগিয়ে যেতে চায় আস্ট্রেলিয়া। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের অঞ্চলকে ‘নিরাপদ, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ’ রাখার জন্য প্রযোজ্য বিষয়গুলোর প্রতি আস্থা রাখতে চান।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তিনি বলেন, এ সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও অন্যান্য আঞ্চলিক সঙ্গী এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করে যাবেন। ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা বাংলাদেশের পাশে থাকব।’
হাইকমিশনার বলেন, নির্যাতনের জবাবদিহি ও রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে কাজ করে যাবে অস্ট্রেলিয়া। সেই সাথে অস্ট্রেলিয়া রাখাইন উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে উত্সাহ দেয়া অব্যাহত রাখবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মাঝে আস্থা তৈরি এবং তাদের ফেরার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান পেতে চেষ্টা ও সাহায্য করতে অস্ট্রেলিয়া তাদের আওতাধীন অনেক উপায় ‘কূটনৈতিক, দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ’ ব্যবহার করছে বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে অবস্থানের ফলে মৌলবাদ, শোষণ ও বহুজাতিক অপরাধের ঝুঁকির বিষয়টি তারা উপলব্ধি করেন জানিয়ে জুলিয়া নিবলেট বলেন, এ বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে। ‘আমার মতে এসব বিষয় মোকাবিলার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো প্রতিরোধ।’
অস্ট্রেলিয়া ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদারতা স্বীকার করে উল্লেখ করে হাইকমিশনার বলেন, সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা স্থানীয়দের মানবিক চাহিদা পূরণে অস্ট্রেলিয়া সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে মানবিক সহায়তায় ১২২ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে।
সংলাপে ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মাঝে প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তার মতে, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরএ) ও তার বাইরের দেশগুলোর মাঝে সহযোগিতার রোমাঞ্চকর সম্ভাবনা রয়েছে।
সমুদ্র অর্থনীতির যুগে সহযোগিতার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার বলেন, প্রথমিকভাবে তারা সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখছেন।
জুলিয়া নিবলেট বলেন, বহু বছরের অভিবাসন, খেলাধুলা ও শিক্ষার কল্যাণে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মাঝে জনগণের সাথে জনগণের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশি বংশদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ায় বাস করছেন এবং সেখানে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৭ হাজার। শিক্ষার্থীদের এ সংখ্যা বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মাধ্যকার বাণিজ্য গত এক দশকে ৫৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে উভয়-পথে পণ্য ও সেবাসহ প্রায় ২৫০ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলারের বাণিজ্য হয়েছে।
তৈরি পোশাক শিল্প ও কৃষিপণ্যকে এ বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিত্তি-প্রস্তর হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হচ্ছে।
হাইকমিশনার বলেন, তারা হিংস্র উগ্রবাদ দমনে বাংলাদেশকে সহায়তা দিচ্ছেন। ‘এটি আমাদের অবশ্যই একসাথে মোকাবিলা করতে হবে। পুলিশ স্টাফ কলেজের মাধ্যমে আমরা পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে অস্ট্রেলিয়া স্বল্পমেয়াদি কোর্সের সুযোগ দিয়ে থাকে।’
প্রযুক্তিগত এবং ডিজিটাল রূপান্তরে বাংলাদেশের দৃঢ় নজর রয়েছে উল্লেখ করে জুলিয়া নিবলেট প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সুবিধা কাজে লাগাতে দুই দেশের তরুণদের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ডিজিটাল বাণিজ্য, সাইবারক্রাইম, উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তি, ডিজিটাল সেবা সরবরাহ এবং ইন্টারনেট পরিচালনা ও সহযোগিতা বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে কাজ করার জন্য অস্ট্রেলিয়ার উল্লেখযোগ্য দক্ষতা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ‘এসবের কিছু ক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সাথে কাজ করেছি, তবে আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারি।’
এ সময় এনায়েতুল্লাহ খান বলেন, হাইকমিশনার নিবলেট তার অসাধারণ ও চলমান মেয়াদকালে বাংলাদেশের প্রতিটি কোণে অস্ট্রেলিয়ান পতাকা বহন করে নিয়ে গেছেন এবং শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন।
‘আমার সন্দেহ নেই যে আপনার উপস্থিতি অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে শুধুমাত্র বিস্তৃত ও গভীরই করবে না, সেই সাথে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যেতে পথ দেখাবে,’ যোগ করেন তিনি।
এনায়েতুল্লাহ খান জানান, কসমস ডায়ালগের পরবর্তী বিশিষ্ট বক্তা হবেন ইউরোপীয় রাজনীতির ময়দানের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় স্লোভেনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. দানিলো তুর্ক। তিনি বর্তমান ইউরোপীয় রাজনীতিতে চিন্তা বিস্তারকারী নেতা হিসেবেও ভালো পরিচিত।