সোনারগাঁও উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে চার সহস্রাধিক জামদানি তাঁত রয়েছে। এর মধ্যে আলমদীচরভুলা, মালিপাড়া, সাদিপুর, ব্রাহ্মণবাওগাঁ, খেজুরতলা, কাজিপাড়া, চৌরাপাড়া, মুছারচর, শেকেরহাট, বাসাবো, তিলাব, বস্তল, কলতাপাড়া, কাহেনা, গনকবাড়ি, ওটমা, রাউৎগাঁও, নয়াপুর, উত্তর কাজিপাড়া, চেঙ্গাইন, খালপাড় চেঙ্গাইন, ভারগাঁও, কান্ধাপাড়া, ফিরিপাড়া, বাইশটেকি, আদমপুর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তাঁত রয়েছে।
সরেজমিনে ইউনবি’র প্রতিনিধি দেখেন, সোনারগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকায় জামদানিশিল্পী ও কারিগরদের বাড়িতে এখন সবাই ব্যস্ত। ঈদ সামনে রেখে কারিগরদের আয় বেড়েছে। একটু ফিরে তাকানোর সময় নেই তাঁতীদের। এখানকার তাঁতীদের অধিকাংশই শিশু থেকে মধ্য বয়স্ক। তবে কম বয়সী তাঁতীরাই জামদানিশিল্পের সঙ্গে বেশি জড়িত। কারিগরদের রাত-দিন কাজ করতে হচ্ছে। এসব শাড়ি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অভিজাত দোকানে এবং বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে।
সোনারগাঁওয়ে শিল্পীদের ঘরে ঘরে এখন নানা ডিজাইনের জামদানি শাড়ি তৈরি হচ্ছে। অতীতের মসলিনের মতোই, আজকের জামদানি শাড়ির শিল্প-সৌন্দর্যের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। কেবল দেশের বাজারেই নয়, বিশ্ববাজারেও জামদানির ব্যাপক চাহিদা গড়ে উঠেছে।
এদিকে সোনারগাঁওয়ে জামদানিশিল্পের সোনালি দিন এখন আর নেই। জামদানি উৎপাদনকারী শিল্পীরা হতাশাগ্রস্ত। তারা সঠিক দাম পাচ্ছেন না। অধিকাংশ তাঁতিই মহাজনদের কাছে দেনার দায়ে বাঁধা। তারা মহাজনদের দাদন গুনছেন, পাচ্ছেন শুধু মজুরি। সরাসরি তারা শাড়ি বাজারজাত করতে পারছেন না। তাঁতিরা মহাজনদের কাছ থেকে সুতা নিয়ে যান। পরে তাদের দেওয়া নকশা অনুযায়ী শাড়ি তৈরি করেন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে হাড়ভাঙা খাটুনির পর তারা মজুরি পান। অথচ জামদানিই হচ্ছে বাংলার হারিয়ে যাওয়া মসলিনের বিকল্প প্রতিরূপ।
জামদানি কারখানার মালিকরা জানান, আগে জামদানিশিল্পীরা শুধু শাড়ি তৈরিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। তবে বর্তমানে জামদানিশিল্পে এসেছে নতুনত্ব। শাড়ি তৈরির পাশাপাশি থ্রি পিস, ওড়না, পাঞ্জাবি, পর্দার কাপড়ও তৈরি হচ্ছে এখানে। ঈদকে সামনে রেখে জামদানি শাড়ির চাহিদা বেড়ে গেছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী এবার আরও উন্নত এবং নতুন নতুন ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করছেন কারিগররা।
সনমান্দী ইউনিয়নের আলমদীচরভুলা এলাকার জামদানি কারিগর সবুজ মিয়া, মো. মতিন ও আবুল কাসেম বলেন, প্রতিকূলতার মাঝেও আমরা জামদানি উৎপাদন করছি। এখানে ১০০০ টাকার নিচে কোনো জামদানি শাড়ি তৈরি হয় না। সর্বোচ্চ ২২ হাজার টাকা দামের শাড়িও এখানে তৈরি হয়। তবে এখন এই দামে অর্ডার পাওয়া যায় না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জামদানিশিল্প দেশের রপ্তানি খাতে বিশেষ অবদান রাখতে পারত।
জামদানি শাড়ি বিক্রেতা আওলাদ হোসেন জানান, পুরো কাপড়ে নকশা করে উন্নত মানের একটি ভালো শাড়ি তৈরিতে অনেক সময় দেড় দুই মাস র্পযন্ত সময় লেগে যায়। সময় আর কাজের ওপর দাম নির্ভর করে। এ বস্ত্রের জমিন একাধিক রঙের হয়ে থাকে। জামদানি তাঁতীদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কেবল রয়েছে বংশানুক্রমিক হাতে-কলমে অর্জিত দক্ষতা। নারায়ণগঞ্জ জেলার নির্দিষ্ট কয়েকটি গ্রামেই এ শাড়ি তৈরি হয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, সৌদি আরব, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে জামদানি শাড়ি রপ্তানি হচ্ছে। এ রপ্তানির সঙ্গে জড়িত জামদানি শাড়ির ব্যবসায়ীরা। তাঁতীদের কাছ থেকে তারা শাড়ি কিনে এনে রপ্তানি করেন।
ফলে বৈদেশিক মুদ্রা তাঁতিদের ঘরে ওঠে না। চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের হাতে। প্রতি বছর সোনারগাঁও এবং রূপগঞ্জ এলাকা থেকে প্রায় ৪০-৫০ কোটি টাকার জামদানি শাড়ি রপ্তানি করা হয়।
সোনারগাঁও জামদানি তাঁতী প্রাথমিক সমিতির সভাপতি মজিবুর রহমান বলেন, বর্তমানে জামদানি শিল্পীদের দুর্দিন যাচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীরাই লাভ খাচ্ছে। সহজ-সরল নারী, অসচ্ছল ও নিরীহ জামদানি তাঁতীরা এক শ্রেণির দাদন ব্যবসায়ী মহাজনদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জামদানিশিল্প দেশের রপ্তানি খাতে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।