বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, দৃশ্যমান কোনো লক্ষণ ছাড়াই করোনায় আক্রান্ত মানুষের অবাধ বিচরণের মাধ্যমে সারা দেশে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে এবং সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাবে। কারণ প্রতিনিয়ত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকা সত্ত্বেও সরকার ধীরে ধীরে শাটডাউন শিথিল করছে।
এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দিকনির্দেশনা যেমন- মাস্ক, গ্লাভস ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, নিরাপদে থাকার জন্য ঘন ঘন হাত ধোয়া ইত্যাদি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জার্নাল সায়েন্সে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, চীনের অভ্যন্তরে ৭৯ শতাংশ করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে উপসর্গহীন অথবা হালকা লক্ষণযুক্ত মানুষের মাধ্যমে, কারণ তাদের মনে হয়েছিল ভ্রমণ করার জন্য তারা যথেষ্ট সুস্থ রয়েছেন।
ইতালি ভিত্তিক একটি সমীক্ষায়ও একইভাবে বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়েছে যে দেশটিতে ৫০-৭৫ শতাংশ করোনাভাইরাস বাহকই উপসর্গহীন।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) জানিয়েছে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ৮০ শতাংশই উপসর্গহীন বা হালকা লক্ষণযুক্ত, তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো গবেষণা হয়নি।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (রোগ নিয়ন্ত্রণ) সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে উপসর্গহীন রোগী বা নীরব বাহকরা একটি মুখ্য বিষয়। আমরা জানি না আমাদের দেশে নীরব বাহকের সংখ্যা কতো, কারণ এ বিষয়ে আমাদের কোনো গবেষণা নেই। তবে আমরা নিশ্চিত যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো উপসর্গহীন রোগীদের মাধ্যমেই এ ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।’
তিনি বলেন, উপসর্গহীন রোগীদের দ্বারা ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করার প্রধান কৌশল হরো কঠোরভাবে শাটডাউন কার্যকর করা, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা এবং ঘন ঘন হাত ধোয়ার পাশাপাশি সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, ‘সরকার যেহেতু এখন অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কার্যক্রম পুনরায় চালু করার অনুমতি দিচ্ছে, তাই গুরুতর লক্ষণবিহীন মানুষেরা এখন ভাইরাসের ‘সুপার স্প্রেডার’ হয়ে উঠবেন’।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক বলেন, ‘শাটডাউন তোলার আগে সরকারের কিছু প্রস্তুতি নেয়া উচিত। আমরা যদি অপরিকল্পিতভাবে শাটডাউন তুলে নেই, তাহলে আমাদের এর চড়া মূল্য দিতে হবে এবং প্রচুর সংখ্যক উপসর্গহীন রোগীর কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’
ডা. বে-নজীর বলেন, উপসর্গহীন রোগীদের শনাক্ত করে তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ হাজার করোনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এবং আমাদের সীমিত সম্পদ এবং জনশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের ভালো পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে উপসর্গহীন সংক্রমণ শনাক্ত করতে প্রতি ১৫ দিন পর পর তাদের পরীক্ষা করা উচিত। অন্যথায়, নিজেদের অজান্তেই তারা তাদের সহকর্মী এবং রোগীদের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারেন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কোষাধ্যক্ষ এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘ভারতে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশাল সংখ্যক উপসর্গহীন রোগী রয়েছেন। যদিও আমরা এ বিষয়ে কোনো গবেষণার সন্ধান পাইনি, কিন্তু আমরা ধরে নিতে পারি যে এখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষই উপসর্গহীন বা হালকা লক্ষণযুক্ত এবং তাদের বেশির ভাগই অশনাক্ত রয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘নীরব করোনার বাহক শনাক্ত করা এবং তাদের আইসোলেশনে পঠানোই এখন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। উপসর্গহীন রোগীদের মাধ্যম অন্যদের মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের দুটি উপায় রয়েছে। কঠোরভাবে শাটডাউন কার্যকর করা, মানুষকে ঘরে রাখা, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়। অন্য উপায়টি হলো করোনা পরীক্ষার হার বাড়িয়ে সংক্রমিত ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করা এবং তাদের আইসোলেশনে পাঠানো।
ডা. আতিক বলেন, দেশে করোনা পরীক্ষার ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে তারা এখন দীর্ঘ সময়ের জন্য লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার বিষয়টিকেই গুরুত্বের সাথে দেখছেন।
‘সরকার এখন জীবিকার স্বার্থে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় চালু করতে চলেছে। আমরা যদি মাস্ক ব্যবহার করি, যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি, সাবান দিয়ে হাত ধুই এবং জনসমাবেশ এড়াতে পারি, তাহলে আমরা ভাইরাস থেকে নিজেদের কিছুটা রক্ষা করতে সক্ষম হব,’ যোগ করেন তিনি।
সারা দেশে সংক্রমিত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করার মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে করোনা পরীক্ষার সুবিধা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, উপসর্গহীন রোগী বাড়তে থাকায় দেশে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই কঠিন হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বজুড়েই নীরব বা উপসর্গহীন করোনা রোগী খুব বেশি এবং আমাদের দেশেও এ সংখ্যাটি অনেক বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে যেহেতু আমাদের দেশের মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সর্দিজনিত সমস্যায় ভুগে অভ্যস্ত তাই তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো রয়েছে।’
‘কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েও অনেকে এটিকে লুকিয়ে রাখতে পারেন কারণ তাদের মধ্যে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। উপসর্গ না থাকায় অনেকেই আবার নিজের কাছেও আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি অজানা থাকছে। এ কারণেই আমাদের অনেক চিকিৎসক এবং নার্স এ জাতীয় রোগীদের মাধ্যমে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন,’ বলেন ডা. শাহানা।
‘বাড়িতে থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারসহ বিভিন্ন স্বাস্থবিধি নেমে চলাই এ সমস্যাটি কাটিয়ে ওঠার প্রধান উপায়। তবে আমরা তা করতে ব্যর্থ হচ্ছি এবং একটি গুরুতর পরিণতিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি,’ যোগ করেন ঢামেকের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান।
উপসর্গহীন রোগীদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বড় হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে ডা. শাহানা সতর্ক করে বলেন, লকডাউন শিথিল করা হলে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে এবং তাদের মাধ্যমে অন্যরাও সংক্রমিত হতে থাকবে, যার ফলে দেশে মারাত্মক আকার ধারণ করবে করোনা মহামারি।