সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হওয়া সহিংসতায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মেট্রোরেলের দুটি স্টেশন। এখনও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। এদিকে মেট্রোরেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকাবাসীর জীবনে ফিরে এসেছে পুরনো সেই যানজটের ভোগান্তি।
মেট্রোরেলের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএন সিদ্দিক বলেন, ‘মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণটা অনেক বেশি। তবে কত টাকা ক্ষতি হয়েছে, এটি নিরূপণ করা যায়নি। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।’
এছাড়া হামলায় মেট্রোরেলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ এবং কবে নাগাদ এটি আবার চালু করা যায়, তা নির্ধারণে ২২ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএমটিসিএল।
মেট্রোরেল লাইন-৬-এর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়ার নেতৃত্বে এ কমিটি গঠন করা হয়। সদস্যসচিব করা হয় ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) ইফতেখার হোসেনকে। কমিটিকে পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
মেট্রোরেল বন্ধ থাকায় সড়কে বেড়েছে যাত্রীদের চাপ। বেড়েছে যানজটও। রাজধানীবাসীকে ফিরতে হয়েছে আগের সেই ভোগান্তি আর দুর্ভোগের জীবনে। গন্তব্যে পৌঁছাতে এখন উত্তরা ও মিরপুরবাসীকে এখন দুই ঘণ্টার বেশি সময় হাতে নিয়ে বের হতে হচ্ছে।
নিয়মিত মেট্রোরেল ব্যবহারকারী বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় ইউএনবির এই প্রতিবেদকের। তারা বলছেন, মেট্রোরেল চালুর পর থেকে এই স্বস্তির যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। পুরনো অভ্যাসে ফিরতে কেউই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। তার সঙ্গে অর্থ ও সময় দুইই বেশি লাগছে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল ও স্টেশনগুলো সংস্কার করে দ্রুতই চালু করার দাবি জানান তারা।
কবে নাগাদ মেট্রোরেল চালু করা যাবে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘কবে নাগাদ চালু করতে পারব, তা এখনই বলতে পারছি না। ক্ষতিগ্রস্ত দুটি স্টেশন চালু করতে অনেক সময় লাগবে। তবে বাকি স্টেশনগুলো যাতে দ্রুত চালু করা যায় সে বিষয়টি দেখছি আমরা।’
এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মেট্রো স্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে মেট্রোরেলের কারিগরি ক্ষয়ক্ষতি চিহ্নিত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হতে সময় লাগতে পারে অন্তত আরও ১/২মাস। সেটিও নির্ভর করছে জাপানের কারিগরি কমিটির পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত রেলস্টেশনগুলো পরিদর্শনের ওপর। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সবকিছু সংস্কার করে ট্রেন চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব মো. জাকারিয়া বলেন, ‘ কীভাবে সংস্কার কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া যায়, তার একটা রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা যার যার অংশে পরামর্শক, ঠিকাদার ও ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে তালিকা তৈরি করবে। কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণ করতে আরও সময় লাগবে।’
কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা স্টেশনের সব পরিকাঠামো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বোঝা যাবে বলে জানান তদন্ত কমিটির প্রধান।
যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং ডিএমটিসিএলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি পুনরায় চালু করতে এক বছরের বেশি সময় লাগতে পারে।
অন্যদিকে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করলে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনগুলো চালু করা সম্ভব।
ডিএমটিসিএল থেকে জানা যায়, কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন মেরামতে এক বছর বা তার থেকে বেশি সময় লেগে যাবে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত অনেক যন্ত্রপাতিই মেরামতযোগ্য অবস্থায় নেই। এগুলো নতুন করে আমদানি করতে হবে। যন্ত্রগুলো অর্ডার দেওয়া হলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করবে। তারপর বাংলাদেশে এনে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘মেট্রোরেলের টিকিট কাটার মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে বানানো। কমলাপুরে নতুন একটা স্টেশন হবে। সেখানে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। নিশ্চয়ই যে কোম্পানি মেট্রোরেলের যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে, তাদের কাছে সব নকশা করা আছে। সরকার বা প্রকল্প কর্তৃপক্ষ চাইলে সহজেই যন্ত্রপাতিগুলো দেশে এনে স্টেশন দুটির মেরামতকাজ শুরু করতে পারে। আমার মনে হয়, ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি মেরামতে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ কম।’
সরকার দ্রুত সময়ে কাজ শুরু করলে ছয় মাসের বেশি লাগার কথা না বলে মনে করছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক।
ডিএমটিসিএল থেকে জানা যায়, দুর্বৃত্তদের হামলায় মিরপুর-১০ স্টেশনের সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজীপাড়া স্টেশনে বিভিন্ন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হামলায় দুটি স্টেশনে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানোয় প্রবেশ ও বহির্গমন গেট, অগ্নিরোধক দরজা-জানালা, বিভিন্ন ধরনের সাইনেজ, এসএস ফেন্সিং, বিশেষ ধরনের কাঁচের দরজা ও জানালা, স্টেশনের আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ইলেকট্রিক্যাল এবং মেকানিক্যাল সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে অগ্নিনির্বাপক ও শনাক্তকরণ সিস্টেম, ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম, বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, চলন্ত সিঁড়ি, বিশেষ ধরনের সুইচ।
এক মাসের মধ্যে আংশিক (মিরপুরের ক্ষতিগ্রস্ত দুটি স্টেশন ছাড়া) মেট্রোরেল চলাচল শুরু করা যাবে কিনা জানতে চাইলে মেট্রোরেলের কোম্পানি সচিব মো. আব্দুর রউফ বলেন, জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে আমরা এক মাসের মধ্যে মেট্রোরেল চলাচল শুরু করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।