মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিহারিদের দেশের বিভিন্ন কলোনিতে আটক করা হয়। তাদের বেশিরভাগই রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ‘জেনেভা ক্যাম্পে’ (জেনেভা সনদে সুরক্ষা প্রাপ্ত) আশ্রয় নেয়।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিন থেকে সাড়ে চার লাখ বিহারির মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বাস করেন ঢাকাতেই।
মিরপুর-১১ এলাকার বিহারি ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করে ইউএনবি প্রতিবেদক তাদের বসবাস ও জীবনযাত্রার যে পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন তাকে এক কথায় ভয়াবহ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। পানির সংযোগে সমস্যা দেখা দিলে একমাত্র পানির পাম্পটি থেকে পানি সংগ্রহে বিশাল ভিড় লেগে যাওয়া সেখানে নিয়মিত ব্যাপার।
উর্দুভাষী যুব পুনর্বাসন আন্দোলন বাংলাদেশের (ইউএসওয়াইআরএমবি) সভাপতি সাদাকাত খান ফাক্কু বলেন, ‘মিরপুরের ক্যাম্পগুলোর বাসিন্দারা উচ্ছেদের হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন দলের লোকজন তাদের ভয়ও দেখাচ্ছে।’
‘সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ রাস্তা থেকে অবৈধ স্থাপনা সরানোর নামে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে চায়। তবে তারা আমাদের পুনর্বাসনের জন্য কোনো নির্দেশনা দেয় না। আমরা কোথায় যাব?’ বলেন তিনি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, অতীতেও তারা এরকম বিপদের সম্মুখীন হলেও কেউ তাদের কান্নায় সাড়া দেয়নি। ‘একাধিকবার আমাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। আগে থেকেই জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে।’
‘আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি যে অন্য কোনো কিছু করার আগেই আমাদের যথাযথ পুনর্বাসন যেন নিশ্চিত করা হয়,’ আবেদন জানান তিনি।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ ৯ সেপ্টেম্বর মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বিহারিদের বাসস্থান বিষয়ে আদেশে দুই মাসের জন্য স্থিতি অবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেয়। সেই সাথে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এবং ডিএনসিসিসহ ২৪ প্রতিষ্ঠানের জন্য রুল জারি করে।
এ সময় শেষ হওয়ার পর কী হবে সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নন ক্যাম্পে বসবাসকারীরা।
‘আমরা কোনো জমি কিনতে পারি না। আমাদের কোথাও বাড়ি নেই... আমরা অন্যায় কিছু চাইছি না। কেবল বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকার সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি,’ বলেন এডিসি বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা লিটন।
‘কেউ আমাদের নিয়ে কথা বলেন না। আমাদের মধ্যে কেউ যদি উন্নত জীবনযাপনের জন্য আইনিভাবে জমি কিনতে চান, তবে ‘বিহারি’ হওয়ার কারণে তাকে বঞ্চিত হতে হয়,’ যোগ করেন তিনি।
লিটন আরও বলেন, ‘কয়েক বছর আগে কক্সবাজারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা এসেছে। আমাদের তুলনায় তাদের অনেক বেশি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা গত ৪৬ বছর ধরে এ দেশে থাকলেও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করছি।’
মিরপুর-১১ এলাকার অস্থায়ী বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা মাকসুদ খান বলেন, তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি হয়েছে খুবই কম, বলতে গেলে হয়নি।
‘আটকে থাকা প্রতিটি বিহারির ভাগ্যই একই রকম...আমরাও বাংলাদেশের নাগরিক। আমি নিজে এখানে জন্মগ্রহণ করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই আশ্বাস দিয়েছেন যে আমাদের অধিকার সংরক্ষণ করা হবে, তবে আমরা এখনো এর কোনো সুফল দেখতে পাইনি।’
মকসুদ ইউএনবিকে বলেন, বিহারি শিশুদের পড়াশোনা ও বিনোদনের ব্যবস্থাও অপ্রতুল। কয়েকটি এনজিওর সহায়তায় কিছু স্কুল খোলা হলেও আর্থিক সহায়তার অভাবে সেগুলো বন্ধ করে দিতে হয়েছে। শিশুদের খেলার জন্য কোনো মাঠ নেই বলেও জানান তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ বিশ্লেষণ’ নামে এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উল্লেখিত অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বিহারিদের পুনর্বাসন কাজের জন্য কোনো ধরনের বরাদ্দ দেয়া হয়নি।
এদিকে বেনারসি শিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকায় বর্তমানে একজন বিহারির প্রধান আয়ের উৎস হয়ে উঠছে ছোট কোনো ব্যবসা বা স্বল্প সময়ের জন্য চাকরি করা।
‘খুব কম বিহারিরই তাদের পৈত্রিক পেশা বেনারসি বুনন এবং করচুপির কাজ শেখার প্রতি আগ্রহ আছে,’ জানান ফুটবল গ্রাউন্ড বিহারি ক্যাম্পের এক বাসিন্দা।
ক্যাম্পের অপর বাসিন্দা মো. সেলিম বলেন, ‘বেশিরভাগ বিহারির জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভোট দেয়ার অধিকার থাকা সত্ত্বেও পাসপোর্ট করার অনুমতি পান না।’
তিনি বলেন, ‘পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার বিহারি ক্যাম্পের ঠিকানা ব্যবহার করলে ‘স্থায়ী’ ঠিকানা না থাকার কারণে আবেদনটি নিশ্চিতভাবেই প্রত্যাখ্যাত হয়।’
ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, মিরপুর ও ডিএনসিসির বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে নির্মাণ করা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।
‘এসব এলাকায় জনগণের চলাচলকে ব্যাহত করে এমন সব স্থাপনা নাগরিকদের সুবিধার স্বার্থে উচ্ছেদ করা হবে,’ তিনি ইউএনবিকে জানান।
তবে, কেউ অবৈধভাবে রাস্তা দখল না করে থাকলে কাউকে উচ্ছেদ বা বাস্তুচ্যুত করা হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।