হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে, বিশেষ করে করোনাভাইরাসের এ সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা যেন আরও খারাপ না হয় সে জন্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে (বিএফএসএ) যত দ্রুত সম্ভব খাবারে ট্রান্সফ্যাট কমাতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
নীতিমালার অভাবে ট্রান্সফ্যাটজনিত হৃদরোগ ঝুঁকি বেড়েই চলেছে: প্রজ্ঞা
অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবারগুলো থেকে বিভিন্ন রোগ, বিশেষত হৃদরোগ সৃষ্টি হয় জানিয়ে অস্বাস্থ্যকর এসব খাবার এড়িয়ে চলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে এ ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারত্মক প্রভাব ফেলতে পারে কারণ মহামারিজনিত কারণে অনেকে ব্যায়াম করা থেকে বিরত রয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, কেবলমাত্র ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫,৭৭৬ জন মারা যান, অর্থাৎ প্রতি মাসে ৪৬০ জন।
ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতি চালু করতে যত বেশি সময় লাগবে, অনিচ্ছাকৃত প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সংখ্যাও তত বাড়বে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে প্রতি বছর হৃদরোগে প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
ট্রান্সফ্যাটজনিত মৃত্যুতে সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ
ডব্লিউএইচও ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ চেইন থেকে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো হ্রাস করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
ভারত, থাইল্যান্ড, ইরান, অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলসহ প্রায় ৩০ দেশ ইতোমধ্যে খাবারে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়া খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা ২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে আরও ২৪ দেশ।
২০২৩ সালের মধ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করার লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও ২০১৮ সালে ডব্লিউএইচও কর্তৃক ঘোষিত ‘রিপ্লেস অ্যাকশন প্যাক‘ বাস্তবায়ন থেকে এখনও অনেক দূরে রয়েছে বাংলাদেশ।
ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের ফলে মৃত্যু এড়াতে বাংলাদেশের জরুরি পদক্ষেপ চায় ডব্লিউএইচও
সম্প্রতি ঢাকায় ডালডা বা বনস্পতি ঘি হিসেবে পরিচিত ‘পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও)’-এর নমুনার ৯২ শতাংশে ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত ২ শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি।
ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডগুলোর নমুনা বিশ্লেষণ করে এ ফলাফল পান ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এনএইচএফএইচআরআই) গবেষকরা।
গবেষণায় পিএইচও নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রামে গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া যায়। এছাড়া, একই ব্র্যান্ডের পিএইচও নমুনার মধ্যে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতির ব্যাপক তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। যেমন, একটি পিএইচও ব্র্যান্ডের সাতটি নমুনায় ০.৬৯ গ্রাম থেকে শুরু করে ১৪.৫ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।
ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
দেশে পিএইচও বা ডালডা সাধারণত ভাজা পোড়া স্ন্যাক্স ও বেকারিপণ্য তৈরি এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, খাবারে ট্রান্সফ্যাট এক অযাচিত বিষাক্ত উপাদান এবং প্রতিদিনের খাদ্যদ্রব্যের সাথে এটি গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। দ্রুত এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এবং কঠোরভাবে তা প্রয়োগের মাধ্যমে খাবারের ট্রান্সফ্যাট থেকে মৃত্যু সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
তিনি ইউএনবিকে বলেন, ‘ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি প্রণয়নে বিলম্বের কারণে দেশে অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধযোগ্য অকাল মৃত্যু বাড়ছে। সুতরাং, এ বিষয়টি দ্রুত বিবেচনায় নেয়া উচিত। সুস্থ থাকার জন্য মানুষকে ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবারগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।’
সরকারকে সব তেল এবং খাবারে মোট ফ্যাটের মধ্যে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ ২ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা এবং লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষার জন্য দ্রুত এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের আহ্বান জানান জুবায়ের। ‘হার্ট হেলথ’ শিরোনামে তার সংগঠনটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রচারণা চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ট্রান্সফ্যাটমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বিলম্ব করার ক্ষেত্রে কোনো অজুহাত থাকতে পারে না। ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের মাধ্যমে প্রতি বছর হৃদরোগ থেকে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব।’
শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটকে বিষাক্ত নীরব ঘাতক উল্লেখ করে বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক এনামুল হক বলেন, ‘খাবারে উচ্চ মাত্রার ট্রান্সফ্যাট খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) বৃদ্ধি করে এবং মানবদেহে ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) হ্রাস করে।’
এনামুল জানান, উচ্চ মাত্রার ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ রক্তের প্রবাহকে ব্যাহত করার পাশাপাশি দ্রুত হার্ট অ্যাটাক এবং অকাল মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ট্রান্সফ্যাটগুলো প্রায়শই ফাস্টফুড, স্ন্যাক্স, বিস্কুট, মার্জারিনসহ প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলোতে পাওয়া যায়।
ঢাকায় ডালডার নমুনার ৯২ শতাংশে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট: গবেষণা
বিএসটিআই একটি নীতিমালা প্রণয়ন এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশিরা ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার সম্পর্কে সচেতন নয়, তাই এ জন্য একটি নীতিমালা আবশ্যক। কোম্পানিগুলোকে খাদ্যসামগ্রীতে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ ট্রান্সফ্যাট ব্যবহারের নিয়ম প্রয়োগে বাধ্য করতে হবে।’
নীতি প্রণয়নের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসএফএ চেয়ারম্যান মো. আবদুল কাইয়ুম সরকার জানান, ট্রান্সফ্যাট সম্পর্কিত নীতির প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
‘প্রস্তুত করা নীতিমালার প্রাথমিক খসড়া নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা করার জন্য টেকনিক্যাল কমিটি শিগগিরই একটি সভা ডাকবে। আমরা আশা করি আগামী ছয় মাসের মধ্যে এটি চূড়ান্ত হবে,’ বলেন তিনি।