কর্মকর্তারা বলছেন, উৎপাদন ও সেবা খাত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি লকডাউন পরবর্তী সময়ে অগুরুত্বপূর্ণ ব্যয় বিপুলভাবে হ্রাস পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কর সংগ্রহে এ নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পরোক্ষ কর সংগ্রহ
তথ্য অনুযায়ী, রাজস্ব বোর্ড সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকার বিপরীতে ৩০ জুন পর্যন্ত আহরণ করেছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থবছরের জন্য মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দেশে প্রচলিত করবর্ষ হলো ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত।
আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংগ্রহ ছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। গত এক দশক ধরে দেশে রাজস্ব আহরণ বাড়ছিল গড়ে ১৩-১৪ শতাংশ করে। ২০১৮-১৯ মেয়াদে এ প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ ছিল বলে ইউএনবির হাতে আসা এনবিআরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: করের আওতা বাড়াতে এনবিআরের সর্বাত্মক চেষ্টা
কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হওয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সাধারণ ছুটি ও চলাচলে বিধিনিষেধের ফলে মার্চের শেষ দিক থেকে প্রায় তিন মাস পর্যন্ত দেশের উৎপাদন, ভোগ ও আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির ছিল।
প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ
মোট রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকলেও অর্থাৎ আয়করের মতো প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহে ০.৪১ শতাংশের মতো স্বল্প প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) এবং কাস্টমস শুল্ক গত অর্থবছরে যথাক্রমে ৬.৮৬ শতাংশ এবং ৪.৩৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
আরও পড়ুন: শুল্ক আদায় প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন করবে এনবিআর
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ মেয়াদে মূসক আহরণ হয়েছে ৮১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তারপর আয়কর ৭৩ হাজার ২০০ কোটি ও কাস্টমস শুল্ক ৬০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। আগের অর্থবছরে মূসক ৮৭ হাজার ৬১০ কোটি, আয়কর ৭২ হাজার ৯০০ কোটি ও কাস্টমস শুল্ক ৬৩ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা আহরণ হয়েছিল।
জনগণের নির্বিঘ্নে রিটার্ন জমা দেয়ার জন্য প্রতিবার যে আয়কর মেলা হয়ে থাকে তাও মহামারির কারণে বাতিল করতে এবার বাধ্য হয় এনবিআর। তবে বোর্ড তাদের জোনগুলোতে মেলার মতো ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সেখানে করদাতাদের উপস্থিতি সন্তোষজনক ছিল না। তাই বোর্ড বাধ্য হয়ে রিটার্ন জমা দেয়ার শেষ সময় ৩০ নভেম্বর থেকে বাড়িয়ে আরও এক মাস বৃদ্ধি করে।
ই-ডিভাইসের প্রচলন
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট ফাঁকি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইলেকট্রনিক ফিসকেল ডিভাইস (ইএফডি) চালু করেছে এনবিআর।
আরও পড়ুন: ভ্যাট আদায়কে ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন শাখাকে এনবিআরের নির্দেশ
নিয়ন্ত্রণ বোর্ড প্রথম পর্যায়ে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ইএফডি স্থাপন করেছে। ডিভাইসগুলো এনবিআর সার্ভারের সাথে সংযুক্ত এবং লেনদেনগুলো রিয়েল-টাইম ভিত্তিতে ধরা পড়বে।
প্রায় ২৪ ধরনের পণ্য ও সেবা ইএফডি-এর আওতায় আসবে যেসব ব্যবসায়ের বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকার বেশি।
সাধারণ ক্ষমার কর্মপরিকল্পনা
তবে, কর ও জরিমানা দিয়ে মানুষের কালো টাকা সাদা করার পরিকল্পনা তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এনবিআর জানিয়েছে, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এ পরিকল্পনার আওতায় অবৈধ আয়ের ৪০০ কোটি টাকা সাদা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: মূসক ফাঁকি ঠেকাতে ১০ হাজার ইলেকট্রনিক ডিভাইস কিনছে এনবিআর
এর আগে, অবৈধ টাকার মালিকরা আবাসিক স্থাপনা নিমার্ণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে বিনিয়োগ করে তাদের নগদ টাকা বৈধতা পেতেন। নিয়মিত করদাতাদের জন্য যা ১০ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে থাকে। গত অর্থবছর থেকে তাদেরকে এ টাকাগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে প্রত্যেক করদাতাদের প্রতি বর্গমিটারে নির্দিষ্ট হারে শুল্ক প্রদানের মাধ্যমে জমি, বিল্ডিং এবং অ্যাপার্টমেন্টসহ যে কোনো প্রকারের অঘোষিত সম্পত্তি বৈধ করার অনুমতি দেয়া হবে।
ব্যক্তিগত করদাতারাও এবার ১০ শতাংশ হারে ট্যাক্স দিয়ে অঘোষিত নগদ, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটি বৈধ করতে পারবেন। তারা শেয়ার বাজারেও বিনিয়োগ করতে পারবেন এবং এটি তারা তাদের ট্যাক্স রিটার্নেও দেখাতে পারবেন। তবে তার জন্য এসব বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক বছরের লক-ইন সময়কাল মেনে চলতে হবে।
আরও পড়ুন: এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এনবিআরের উপর কালো টাকার মালিকদের আস্থা না থাকায় এই পরিকল্পনা এখনও ভালো কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
চলতি বছয়ে আয়কর রিটার্ন অনলাইনে জমা দেয়া নিয়েও এনবিআর আরও একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে। বাজেটে ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, নতুন করদাতারা অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে ২০০০ টাকা টাকা ছাড় পাবেন। তবে, এ পদ্ধতিটি সঠিকভাবে কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি।