ভ্যানচালক সাইফুল এখন পদ্মা সেতুর কাছে ‘ফুচকা’ বিক্রি করেন। তিনি এখন আগের তুলনায় বেশি উপার্জন করেন। ২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে স্থানীয় পর্যটনে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে, তা তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

তিনি বলেন, ‘আগে ভ্যান চালাতাম। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের তারিখ ধার্য হওয়ার পর থেকেই ভ্যান চালানো বাদ দিয়েছি। এখন ঘুরে ঘুরে ফুচকা বিক্রি করি। আগের চেয়ে রোজগারও ভালো হচ্ছে।’

সাইফুলের মতো অনেক দিনমজুর এই এলাকার ইতিবাচক পরিবর্তনের সুবিধা পাচ্ছেন।

উন্নত যোগাযোগের সুবিধার কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি, শুধুমাত্র পদ্মা সেতু দেখতেও বিপুল সংখ্যক মানুষ এখানে ঘুরতে আসছেন।

সেতুর কাছে অনেক হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট ও পার্ক তৈরি করা হয়েছে। বেশি রোজগারের আশায় অনেকেই তাই নিজেদের আগের পেশা পরিবর্তন করেছেন।

পদ্মা সেতু সংলগ্ন নাওডোবা এলাকায় গড়ে উঠেছে ‘ফুড এক্সপ্রেস’ নামে একটি রেস্তোরাঁ।

রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, আমরাই প্রথম পদ্মা সেতু এলাকায় রেস্তোরাঁ দিয়েছি। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসছে পদ্মা সেতু দেখতে। পদ্মা সেতু দেখা শেষে ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা আমার রেস্টুরেন্টে আসছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘দূর-দূরান্ত থেকে সেতু দেখতে আসা মানুষের রাতে থাকার জন্য এখানে আবাসিক হোটেল নির্মাণের কাজও চলমান রয়েছে।’

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর সুবাদে প্রথমবার গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির সাক্ষী হলো মোংলা বন্দর

স্থানীয় ‘দৈনিক নাগরিক বার্তা’র সম্পাদক মো. কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর ফলে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা আরও বেগবান হবে। কৃষি অর্থনীতিরও নতুন দ্বার উন্মোচন হবে। পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের পর্যটনের নতুন দুয়ার খুলে গেলো। এই সেতুকে ঘিরে ইতোমধ্যেই হোটেল, রেস্তোরাঁ ও রিসোর্ট নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।’

দর্শনার্থী গোলাম মাওলা বলেন, ‘বেসরকারিভাবে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।’

সেতুকে ঘিরে সরকারিভাবে পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।

আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি মনে করি পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের মধ্যে পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আয় করারও সুযোগ তৈরি হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন স্পট হিসেবে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আলতাফ হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুই পাড়ে নতুন স্পট তৈরি হচ্ছে। সেতু ঘিরে পর্যটনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক উদ্যোক্তাই এগিয়ে আসছেন। পর্যটন খাত এ অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও বড় একটি ভূমিকা রাখবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন। এর পরদিন সকাল ৬টা থেকে সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।

উদ্বোধনের পর থেকে ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৭৬ কোটি পাঁচ লাখ ৭০ হাজার ৬৫০ টাকা টোল আদায় হয়েছে।

বাংলাদেশ সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেতু পারাপার হয়েছে মোট ২৭ লাখ ৩৭ হাজার ৫৯০টি যানবাহন। এসময়ে প্রতিদিন গড়ে পদ্মা সেতু পারাপার হয়েছে ১৪ হাজার ৭১৮টি যানবাহন। আর প্রতিদিন গড়ে টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি ১২ লাখ ৫১ হাজার ৯১৭ টাকা।

অন্যদিকে, এটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলছে।

সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন ইউএনবিকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ফলে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলছে। মাত্র ৬ ঘণ্টায় উল্লিখিত পর্যটন আকর্ষণগুলোতে যেতে পারছে পর্যটকেরা।’

সচিব বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। ঢাকার সঙ্গে মোংলা বন্দর, বরিশাল, কুয়াকাটা, পায়রা বন্দর, খুলনা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য জেলার অর্থনৈতিক খাতে এক নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে।’

আরও পড়ুন: প্রথমবারের মতো পদ্মা সেতুতে রাষ্ট্রপতি

তিনি আরও বলেন, ‘যোগসূত্র স্থাপনের ফলে সামাজিক,অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশের অনন্য অবদান রাখছে। পদ্মা সেতু দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পদ্মা সেতুর ফলে পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক দূর সম্প্রসারিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর দুই পাড় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক পদ্মার দুই পাড়ে নান্দনিক সৌন্দর্য দেখার জন্য ঘুরতে যায়। মাওয়া ও শরীয়তপুর প্রান্তে রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট ও হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানাবিধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।’

সচিব বলেন, ‘পর্যটকেদের কুয়াকাটা সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং খুব কম সময়ে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট-কচিখালী, কটকা সৈকত, জামতলা সি-বিচ, সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে জেগে ওঠা দ্বীপ পক্ষীর চর ও ডিমের চর ঘুরে দেখার অপার সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে।’

পর্যটন আকর্ষণ এলাকার নাম উল্লেখ করে সচিব আরও বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণগুলোর মধ্যে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ, ভাসমান পেয়ারা বাজার, ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর, কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইন্সটিটিউট, খান জাহান আলী সেতু, খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর, জাতিসংঘ পার্ক, দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মাজার, রূপসা নদী, শহীদ হাদিস পার্ক, খানজাহান আলী কর্তৃক খননকৃত বড়দীঘি, খুলনা শিপইয়ার্ড, গল্লামারী স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভূমি, জাহানাবাদ বনবিলাস চিড়িয়াখানা ও শিশুপার্ক, পিঠাভোগ, প্রেম কানন বকুলতলা, মোংলা পোর্ট, রাড়ুলী, রেলস্টেশনের কাছে মিস্টার চার্লির কুঠিবাড়ি, সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক ও অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণগুলোর চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

সচিব বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পর্যটকদের সেবাদানের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। সেসব এলাকায় পর্যটন জমে ওঠায় অনেকে এখন আদি পেশা বাদ দিয়ে পর্যটনকেন্দ্রিক নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করছেন এতে তাদের আয়ের পরিমাণ আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে।’

আরও পড়ুন: নিউইয়র্কে পদ্মা সেতুর আলোকচিত্র প্রদর্শনী পরিদর্শন প্রধানমন্ত্রীর