আবার অনেক ছোট বাড়িওয়ালা যারা তাদের বাড়ি থেকে আয়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল তারা বর্তমান পরিস্থিতে ভাড়াটিয়াদের আর্থিক কষ্ট বিবেচনা করে নিজেদের পারিবারিক ব্যয় পরিচালনা করতেও সমস্যায় পড়েছেন।
বাড়িভাড়া পরিশোধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কিছু লোক ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ সরকার বাড়িভাড়া মওকুফ এবং পরিষেবা বিল এক মাসের জন্য স্থগিত করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি বিবৃতি দিয়ে এ বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে।
নগর বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা এ কঠিন পরিস্থিতিতে ভাড়াটিয়াদের ভাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য সরকারের অনুদান, তাদের জন্য খাদ্য রেশন প্রবর্তন এবং ভাড়াটিদের আংশিক ভাড়া মওকুফের বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা নুরুল আলম তার পরিবার নিয়ে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় একটি টিনশেড বাড়িতে মাসিক চার হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন।
ইউএনবিকে তিনি বলেন, ‘আমি মৌচাকের আনারকলি মার্কেটের সামনে বিভিন্ন কসমেটিক আইটেম বিক্রি করে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা উপার্জন করতাম। তবে এখন প্রায় ১০ দিন আমার কোনো আয় নেই। পরিবারকে সাপোর্ট করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাড়িওয়ালা ভাড়া দেয়ার জন্য চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কীভাবে ভাড়া দেব আর পরিবারের জন্য খাবার কিনব তা নিয়ে আমি চিন্তিত।’
নুরুল আলমের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছেন রাজধানীর শান্তিবাগ এলাকার চা বিক্রেতা সেলিম মিয়া। কারণ তাকে বাসা এবং স্টল উভয়েরই ভাড়া দিতে হবে। ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমার উপার্জনের চা স্টল বন্ধ করে দিয়ে আর খুলতে দিচ্ছে না। কিন্তু বাড়ির মালিককে পাঁচ হাজার এবং চা স্টলের মালিককে চার হাজার টাকা দিতে হবে। আর আমার কাছে এখন কোনো টাকা নেই। বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে আমার পরিবার অনাহারে থাকবে।’
মালিবাগ রেলগেটের কাছে মা ও পরিবারের আরও চার সদস্য নিয়ে বস্তিতে বসবাসরত রিকশা-ভ্যান চালক ইসমাইলও উপার্জনের অভাবে গুরুতর অগ্নিপরীক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন। ‘আমি আগে যা কিছু অর্থ সঞ্চয় করেছিলাম তা শেষ হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালা আমাকে এ সপ্তাহে যেকোনো উপায়ে চার হাজার টাকা ভাড়া দিতে অথবা বাড়ি ছাড়তে বলেছে। কীভাবে এটি পরিশোধ করব তা জানি না।’
নগরীর খিলগাঁও এলাকার একটি টিনশেড বাড়ির মালিক আবুল কাশেম জানান, তিনি ভাড়াটিয়াদের থেকে প্রতি মাসে যে প্রায় ২০ হাজার টাকা পান তা তার আয়ের একমাত্র উৎস। ‘আমার ভাড়াটিয়ারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ভাড়া মওকুফ করার অনুরোধ করছেন। তবে ভাড়া না পেলে কীভাবে আমি পরিবার নিয়ে বাঁচব? ’
করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ায় অনেক রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর, হকার, হোটেল ও রেস্তোরাঁর কর্মী, দোকান ও বাজারের কর্মচারী, নির্মাণ শ্রমিক এবং অন্যান্য নিম্ন-আয়ের লোকেরাও একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।
এদিকে, ভাড়াটিয়াদের প্ল্যাটফর্ম ‘ভাড়াটিয়া পরিষদ’ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে রাজধানীর প্রায় ৫০ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের উৎস অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিন মাসের বাড়িভাড়া মওকুফ করার দাবি জানিয়েছে।
এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘শহরের দরিদ্রদের আয় না হওয়ায় বাড়িভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তবে দরিদ্রদের এ সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করার জন্য আমাদের সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই।’
তিনি বলেন, সরকার শহুরে চরম দরিদ্র ও দিনমজুরদের জন্য অনুদান প্রদান করতে পারে যাতে তারা তাদের বাড়িভাড়া আংশিকভাবে এবং পরিবারের জন্য খাবার কিনতে পারেন।
আজিজুল বলেন, অনেক বাড়িওয়ালা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ভাড়া মওকুফ করতে পারবেন। ‘তবে অনেক বাড়ির মালিকদেরও ভাড়া মওকুফ করার ক্ষমতা নেই কারণ এটি তাদের আয়ের মূল উৎস।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, শহরের প্রায় ৪০ লাখ দরিদ্র মানুষ উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। এখন পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে কঠিন।
তিনি বলেন, সরকার তাদের জন্য খাদ্য রেশনিং চালু করতে পারে। ‘তবে তাদের জন্য কোনো অনুদান প্রদান সম্ভবত সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে সরকার মারাত্মক চাপের মধ্যে রয়েছে।’
মুস্তাফিজ বলেন, এনবিআর ঘোষণা করতে পারে যে বাড়ির মালিকদের জন্য কিছু আয়কর মওকুফ করবে, যারা তাদের দরিদ্র ভাড়াটিয়াদের ভাড়ার বোঝা থেকে মুক্তি দেবে। এছাড়াও, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন বলেন, সিটি করপোরেশনের বাড়ির মালিকদের ভাড়াটিয়াদের বাড়িভাড়া থেকে অব্যাহতি দিলে হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করার বিকল্প রয়েছে। ‘তবে এ জাতীয় ব্যবস্থা নেয়া এখনই খুব জরুরি নয়।’
‘আমাদের আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নেয় তাও আমাদের দেখতে হবে,’ তিনি যোগ করেন।
নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, মধ্যবিত্ত লোকেরা কোনোভাবে বাড়িভাড়া ম্যানেজ করবে, তবে নিম্ন আয়ের লোকদের পক্ষে এটি খুব কঠিন।
‘সাধারণত, দরিদ্র লোকেরা অল্প পরিমাণে অর্থ প্রদান করে এবং এটি পাঁচ হাজারের বেশি নয়। সুতরাং, একটি ঘোষণা দেয়া যেতে পারে, যারা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া দেন তারা গার্মেন্টস কর্মীদের মতো সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সহযোগিতা পাবেন,’ তিনি যোগ করেন।