করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন- এমন ভয়ে গ্রামবাসী তার লাশ দাফন করতেও বাধা দেয়। শেষে কবর দিতে না পেরে তার বৃদ্ধ বাবা ফরিদ মিয়ার পক্ষে মেয়ের লাশ মেঘনা নদীর তীরে একটি নৌকায় রেখে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
এমন অবস্থায়, স্বাস্থ্য বিভাগের একটি দল এগিয়ে আসেন। তারা স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় ওই নারীর লাশ কবরস্থানে দাফন করার সব ব্যবস্থা করেন।
নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানার কর্মী সুলতানা বেগম এতটাই দুর্ভাগ্য নিয়ে এসেছিলেন যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন- এ ভয়ে তার আত্মীয়স্বজন এবং গ্রামবাসী স্বামী আমানউল্লাহকে স্ত্রীর লাশটি ছুঁয়ে দেখা বা শেষবারের মতো মুখটি দেখারও অনুমতি দেয়নি।
এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা এটাই প্রমাণ করে কীভাবে মরণঘাতী ভাইরাসের কারণে ঘটা মৃত্যু মানবীয় সম্পর্ক এবং মানবাধিকারকে কেমন পরীক্ষা মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের মৃতদেহ দাফন করতে বা লাশ নিয়ে ঢুকতে বাধা দেয়া হচ্ছে। লাশ থেকে ভাইরাসের সংক্রমণ এলাকায় ছড়িয়ে যেতে পারে এমন ভয় ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার কারণেই নিহতদের দাফন করার বিষয়ে মানুষের এ অনীহা তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে কিছু সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা অনুসরণ করে সমাহিত করলে করোনভাইরাসে আক্রান্তে মৃতদের কবর দেয়ার বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তারা বলেছেন তা হলো করোনভাইরাস দীর্ঘ সময় ধরে মৃতদেহে বেঁচে থাকতে পারে না।
২৪ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ বিষয়ে কিছু নির্দেশনা জারি করেছে। তারা জানায়, ‘এখন অবধি, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গিয়েছেন তাদের মৃতদেহের সংস্পর্শে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলছে, নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্যকে প্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে প্রত্যেকের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া উচিত। প্রত্যেকের হাত রক্ষায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আক্রান্তদের কাছাকাছি যাওয়া উচিত।
এতে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন তাদের কবর দেয়া বা দাহ করা যেতে পারে। তবে, দাফন করা, এতে অংশ নেয়া ও লাশ কবরে রাখার দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের উচিত দাফন শেষ হওয়ার পরে হাতের গ্লাভস খুলে সাবান ও পানি দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলা।
যোগাযোগ করা হলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘ডব্লিউএইচও’র মতে, করোনাভাইরাস মৃতদেহে তিন ঘণ্টার বেশি বেঁচে থাকতে পারে না। তাই, করোনভাইরাসে আক্রান্ত রোগী মারা যাওয়ার চার-পাঁচ ঘণ্টা পরে লাশকে গোসল করানো এবং জানাজা বা দাফন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘লাশটি সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নেয়া উচিত যাতে কোনো ভাইরাস রয়ে না যায়। আমি মনে করি, সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম পরে কোনো করোনার রোগীর মৃতদেহ স্পর্শ করা বা কবর দেয়া বা শ্মশানে নিয়ে যাওয়ায় কোনো ঝুঁকি নেই। এ নিয়ে মানুষের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।’
অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া আরও বলেন, সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে যারা লাশের গোসল করানো বা লাশ দাফনের কাজ করবেন তারা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), মুখের মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস এবং পলিথিন ব্যাগে পুরো শরীর ঢেকে রেখে এ কাজ করতে পারেন।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের (ডিসিএমসিএইচ) মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘যদিও ডব্লিউএইচও বলছে যে মৃতদেহে ভাইরাসটি কয়েক ঘণ্টা পরে মারা যায়, তারপরও লাশগুলো নিয়ে কাজ করার সময় সতর্ক থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, লাশের জানাজা ও দাফনের জন্য অল্প সংখ্যক মানুষকে সম্পৃক্ত করা উচিত।
এ চিকিত্সক বলেন, গোসল করানোর পরে লাশটিকে পুরোপুরি সিল করা এবং অভেদ্য ব্যাগ দিয়ে আবৃত করে দেয়া উচিত এবং মানুষকে মৃতের মুখ দেখানোর জন্য খোলা ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, ‘ডব্লিউএইচও’র মতে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়াদের কবর দেয়াই সবচেয়ে ভালো উপায় এবং কবরস্থান থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে, মানুষদের কবরস্থান জিয়ারত করা থেকে এসময় বিরত থাকা উচিত।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, অনেক ভাইরাস এবং পরজীবী রয়েছে যেগুলো মৃতদেহে বেঁচে থাকতে ও বাড়তে পারে, তবে করোনাভাইরাস মৃতদেহে বাঁচতে পারে না।
তিনি বলেন, তাড়াহুড়া না করে করোনায় মারা যাওয়া রোগীদের সমাহিত করতে কিছুটা সময় নেয়া উচিত।
ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘প্রচলিত পদ্ধতিতে সাবান দিয়ে মৃতদেহের গোসল করাতে হবে। সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেললে ভাইরাসটি বেঁচে থাকতে পারবে না। তাই, করোনভাইরাসে মারা যাওয়াদের নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে, প্রত্যেকেরই সতর্ক থাকতে হবে এবং সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং নিরাপদে থাকার জন্য করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ছাড়া বেশি সংখ্যক মানুষ নিয়ে কোনো ব্যক্তির জানাজা পড়া ঠিক হবে না। যারা জানাজায় অংশ নেবেন তাদেরও সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ও মাস্ক ব্যবহার করা এবং নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে নিরাপদ দূরত্ব মেনে চলতে হবে।’