দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটিতে বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের অনেকেই প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ মহামারি তাদের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আঘাত হেনেছে। একই সাথে আয় উপার্জনের মূলে থাকা পর্যটন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়টিকে বিশেষ বিবেচনা করা উচিত ছিল দাবি করে বাসিন্দাদের অভিযোগ, মহামারি চলাকালীন লকডাউনে সরকারের বিভিন্ন পক্ষ থেকে দেয়া সহায়তা তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই পায়নি। তাই, পরিবারকে সাথে নিয়ে তাদের কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। বিক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের দাবি, সরকারের অবহেলার কারণে তারা সেখানে নাগরিক হিসেবে যে মৌলিক অধিকার পাওয়ার কথা তাও পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রকে সকল নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তারা। এমনকি এর জন্য সরকারকে আদালতের মুখোমুখিও করতে পারেন তারা।
দ্বীপের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলম নামের একজনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, তারা কোভিড-১৯ মহামারিসহ বিভিন্ন কারণে এক কঠিন সময় পার করছেন। ‘এখানে আমাদের সব সময় ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয়। মহামারি আমাদেরকে আরও কঠিন সময়ের সামনে নিয়ে এসেছে।’
আমাদের আয় অনেক কম হলেও আমাদেরকে চাল, তেল, ডাল ও শাক-সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য চড়া দামে কিনতে হচ্ছে, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, দ্বীপে কোনো চিকিৎসক না থাকায় তারা যথাযথ সেবা পান না। সেবা নিতে গেলে তাদের আরও বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় এবং যেকোনো চিকিৎসা সেবার জন্য তাদেরকে জেলা হাসপাতালে যেতে হয়।
আলম বলেন, ‘সরকারের অবহেলায় আমরা এখানে নাগরিক হিসেবে মৌলিক অধিকারগুলো ঠিকভাবে পাচ্ছি না। আমরা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার মধ্যে পড়েছি। তবে, প্রশাসন আমাদের সহায়তা করতে চায় না। আমার শৈশবে এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না বলে পড়াশোনা করতে পারিনি। ভালো শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে আমাদের সন্তানেরা এখানে ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না।’
গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা সেন্টমার্টিনের আবদুল আজিজ নামের এক জেলে বলেন, তারা বছরে বেশিরভাগ সময় মাছ ধরতে যেতে পারেন না। তাই তাদের আয়ও অনেক কমে গেছে।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে আমরা সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকি। মা ইলিশ সংরক্ষণের বিস্তৃত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২২ দিন এবং বর্ষা মৌসুমের ৬৫ দিনসহ বছরে মোট ৮৭ দিন আমরা মাছ ধরতে যেতে পারি না। এছাড়াও, খারাপ আবহাওয়ার সময় ও সপ্তাহের প্রত্যেক শুক্রবার আমরা সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে পারি না। সবকিছু মিলিয়ে বছরে বেশিরভাগ আমাদের অবসর সময় কাটাতে হয়।’
আবদুল আজিজ বলেন, সমুদ্রে কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলেও তারা সরকারের কাছ থেকে যথাযথ সহায়তা পান না। ‘সেন্ট মার্টিনের বর্ধিতাংশ ‘ছেড়া দ্বীপ’ থেকে দূরে গেলে আমরা মোবাইলেও নেটওয়ার্ক পাই না। ফলে গভীর সমুদ্রে যাওয়ার পর ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেলে আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তখন আমরা আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক পাই না।’
আরও উন্নত মোবাইল নেটওয়ার্ক সার্ভিস দেয়ার জন্য দ্বীপটিতে ক্ষমতাসম্পন্ন টাওয়ার স্থাপনে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
যোগাযোগ করা হলে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য হাবিবুর রহমান খান ইউএনবিকে বলেন, নাগরিকদের স্বার্থে মৌলিক অধিকার বিশেষ করে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা অল্প সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করা হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা নাগরিক অধিকার নিশ্চিতে জেলা প্রশাসনকে বহুবার বলেছি তবে তারা এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সরকারেরও উচিত এই দ্বীপের বিভিন্ন বিষয়ে জোর দেয়া কেননা জাতীয় অর্থনীতিতেও আমাদের অবদান আছে।’
তিনি বলেন, দ্বীপটিতে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয় যা কলেজ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে তবে এখানে কোনো ভালো শিক্ষক নেই। তাহলে, প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে।
তিনি আরও জানান, ১০ বছর আগে সরকার এখানে একটি হাসপাতাল করেছে তবে সেখানে কোনো চিকিৎসক বা সরঞ্জাম নেই। ‘তাহলে চিকিৎসা সেবা আমরা পাব কীভাবে,’ প্রশ্ন করেন তিনি। দ্বীপটিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ বাস করে। এখানের ১৪৫৪ জেলের মধ্যে মাত্র ৬০০ জন তালিকাভুক্ত জেলে আছেন। পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাবে মহামারির সময়ে আমরা তাদের সহায়তা করতে পারিনি।
হাবিবুর রহমান বলেন, পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারকে জোর দিতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারি কোনো জাহাজ সেন্টমার্টিনে আসে না। তবে, গত ১২ নভেম্বর থেকে তিনটি বেসরকারি জাহাজ পর্যটকদের নিয়ে এ দ্বীপে আসছে। তার মধ্যে একটি কক্সবাজার থেকে এবং অন্য দুটি টেকনাফ থেকে আসে। এছাড়াও নৌকা করে বেশ কিছু ভ্রমণকারী এখানে ঘুরতে আসেন।
দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার পর্যটক যান। মহামারির প্রভাবে গত ১৯ মার্চ থেকে যা বন্ধ ছিল। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মৌসুমে দ্বীপটিতে সবচেয়ে বেশি পর্যটকদের আনাগোনা হয়।
যত দ্রুত সম্ভব দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় একটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্ল্যান্ট স্থাপন করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানান এ ইউপি সদস্য।
যোগাযোগ করা হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম এ বিষয়ে কোনো গবেষণা না থাকায় দ্বীপবাসীদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।