২০২২ সালের অক্টোবরে রবি আজিয়াটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজীব শেঠি। এর আগে তিনি মিয়ানমারের মোবাইল অপারেটর ওরেডুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি এয়ারটেল আফ্রিকার প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ভোডাফোন, এইচপি, হাচিসন টেলিকম ও এশিয়ান পেইন্টসের মতো বিখ্যাত কোম্পানিগুলোতেও নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কেটিং, ফাইন্যান্স ও অপারেশনে এমবিএ করা শেঠির পরিচয় নতুন নয়। এর আগে তিনি গ্রামীণফোনের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইউএনবির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রবির প্রবৃদ্ধি, বাংলাদেশের টেলিকম খাতে তার অভিজ্ঞতা এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে কথা বলেন শেঠি।
ইউএনবি: ২০২৩ সালে রবির আয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে। মুনাফাও বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন কি?
রাজীব শেঠি: রেকর্ড গড়া জরুরি নয়। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য প্রতি বছর নিজস্ব রাজস্ব রেকর্ড ভাঙা সাধারণ। তবে ২০২৩ সালে রবির ব্যবসা সম্প্রসারণের হার চোখে পড়ার মতো। প্রতিষ্ঠানটির ২৭ বছরের ইতিহাসে গত বছর সর্বোচ্চ রাজস্ব ও মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া ২০২৩ সালে রবির প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের অন্য সব টেলিকম কোম্পানিকে ছাড়িয়ে গেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রবির প্রবৃদ্ধি ছিল অতুলনীয়।
ইউএনবি: এই সাফল্যের পেছনে কোন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে আপনি মনে করেন?
রাজীব শেঠি: এটা নিরন্তর প্রচেষ্টার ফল। আমরা আমাদের নেটওয়ার্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করেছি। আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, বর্তমানে ভয়েস কল ও ইন্টারনেট ব্যবহার উভয়ের জন্যই রবির উন্নত নেটওয়ার্ক রয়েছে। এটি আমাদের সাফল্যের একটি মূল কারণ। আমরা আমাদের ইন্টারনেট ও মিনিট প্যাকেজগুলো ব্যবহাকারীবান্ধব ও সহজ করেছি। আমাদের গ্রাহকদের চাহিদাগুলো পূরণ করে এমন প্যাকেজগুলো সরবরাহ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের ব্র্যান্ডিং প্রচেষ্টাও সফল হয়েছে। আমরা 'পারবে তুমিও' নামে একটি নতুন ব্র্যান্ডিং ক্যাম্পেইন চালু করেছি।
ইতিবাচক ব্যবসায়িক ফলাফল এই সমস্ত প্রচেষ্টার চূড়ান্ত পরিণতি।
ইউএনবি: ১৯৯৭ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করা সত্ত্বেও রবি কেন তার প্রতিযোগীদের মতো একই পর্যায়ে মুনাফা অর্জন করতে পারছে না?
আরও পড়ুন: অল্প সময়ের মধ্যে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেবে ইভ্যালি: সিইও রাসেল
রাজীব শেঠি: এখানে একাধিক ফ্যাক্টর কাজ করে। সংখ্যা ও গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর বিষয় এখানে জড়িত। গ্রাহক সংখ্যা যত বেশি, রাজস্ব ও মুনাফা তত বেশি। গ্রাহকের সংখ্যা বেশি হলে গ্রাহকপ্রতি পরিচালন ব্যয় কমে যায়। টেলিকম খাতের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায়, ছোট অপারেটরদের পক্ষে মুনাফা বাড়ানো চ্যালেঞ্জিং।
বিশ্বব্যাপী, এই ছোট সংস্থাগুলো রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে এ বিষয় উত্থাপন করা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটা শুধু কোনো একক অপারেটরের লাভ-লোকসানের বিষয় নয়। বাজারে কোনো প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য থাকলে গ্রাহকরাই লোকসানে পড়েন।
ইউএনবি: বাংলাদেশের টেলিকম সেক্টরের অভিজ্ঞতা আপনার আছে। এই খাতের নিয়মকানুন, নীতিমালা ও অন্যান্য বিধিবিধান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
রাজীব শেঠি: এই প্রশ্ন বিভিন্ন উপায়ে করা যেতে পারে। একটি দৃষ্টিকোণ হলো, জনসংখ্যার অধিক ঘনত্বের কারণে বিনিয়োগের জন্য এই দেশের টেলিকম খাত আকর্ষণীয়, যা টেলিকম অবকাঠামো স্থাপনের জন্য সুবিধাজনক। জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ তরুণ এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে তারা আগ্রহী। অনেক বাড়িতেই ব্রডব্যান্ড সংযোগ ছাড়াই টেলিকম খাতের জন্য বেশ সুযোগ করে দেওয়া হয়। তবে এই খাত অত্যন্ত উচ্চ করের বোঝায় জর্জরিত। ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে ৫৬ টাকা যায় সরকারের হাতে, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ। বিভিন্ন স্তরে টেলিকম পরিষেবা দেওয়ার জন্য সমন্বিত লাইসেন্সের অনুপস্থিতির কারণে কোনো সংস্থা স্বাধীনভাবে সব পরিষেবা সরবরাহ করতে পারে না এবং অবশ্যই টাওয়ার কোম্পানির উপর নির্ভর করতে হবে। এই নির্ভরশীলতা শুধু ব্যয়ই বাড়ায় না বরং পরিষেবার মানেও প্রভাব ফেলে।
ইউএনবি: বাংলাদেশে বসবাসরত একজন ভারতীয় হিসেবে আপনি দুই দেশের নেটওয়ার্কের মানের তুলনা কীভাবে করবেন?
রাজীব শেঠি: আসলে মানের উপর তুলনার নির্ভর করে। তবে এটুকু বলতে পারি, ঢাকায় আমি যে নেটওয়ার্কের যে মান অনুভব করি তা দিল্লির নেটওয়াকের মানকে ছাড়িয়ে গেছে।
ইউএনবি: বাংলাদেশে গ্রাহকদের কাছ থেকে সেবার মান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে বাড়িতে নেটওয়ার্ক কভারেজের অভাব ও কল ড্রপ। এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
রাজীব শেঠি: মানুষ যখন কোনো পরিষেবা নিয়ে অসন্তুষ্ট হয় তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের অভিযোগগুলো প্রকাশ করে এটি খুবই সাধারণ, যখন তারা সন্তুষ্ট থাকে এর ঠিক বিপরীত হয়। প্রতিদিন করা লাখ লাখ কল দেওয়া, ত্রুটিপূর্ণ রেডিও তরঙ্গের কারণে কয়েকটি কল ড্রপ অনিবার্য। কলড্রপের হার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় মানের চেয়ে বেশি কি না তা মূল্যায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রবির কলড্রপের হার ০.২, যা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। যাইহোক, আমরা ক্রমাগত আমাদের সেবা উন্নত করার চেষ্টা করি। আমরা কক্সবাজারের উখিয়ার মতো কিছু চ্যালেঞ্জিং স্থানে টাওয়ার স্থাপনের চেষ্টা করছি, কিন্তু টাওয়ার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
ইউএনবি: ঢাকায় টাওয়ারের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন আছে কি?
রাজীব শেঠি: অবশ্যই। আমাদের কাছে প্রায় ৬০০টি টাওয়ার স্থাপনের সরঞ্জাম রয়েছে, তবে স্থানের সীমাবদ্ধতার কারণে সেগুলো বর্তমানে আমাদের গুদামে অব্যবহৃত রয়েছে। আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও টাওয়ার কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করছি। টাওয়ার বিনিময়ের ধারণাটি আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে এবং আমরা সেই সম্ভাবনা খুঁজছি।
ইউএনবি: বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়াতে কী কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে?
রাজীব শেঠি: বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ তাদের স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য, স্মার্টফোনগুলোকে আরও সাশ্রয়ী করা বা সামথ্যের মধ্যে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; বর্তমানে এ দেশে এটি বেশ ব্যয়বহুল। স্থানীয় কোম্পানিগুলো স্মার্টফোন উৎপাদন শুরু করেছে এবং কীভাবে তাদের দাম কমানো যায় সে বিষয়ে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন: এজেন্ট ব্যাংকের আউটলেটে ১৪,৩০৫ কোটি টাকা জমা: ইসলামী ব্যাংকের সিইও
ইউএনবি: সরকার উচ্চগতির ৫-জি ইন্টারনেট পরিষেবা বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা করছে। পরিষেবা সরবরাহকারীরা কি প্রস্তুত এবং বাজারে কি ৫-জি’র চাহিদা রয়েছে?
রাজীব শেঠি: আমরা সার্ভিস প্রোভাইডাররা ৫জি-র জন্য তৈরি। তবে বাজারের প্রস্তুতি আলাদা বিষয়। তবে ৫-জি গড় ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে না, কারণ বর্তমান ইন্টারনেটে মুভি দেখার অভিজ্ঞতার মতোই হবে। ৫-জির আসল প্রয়োজনীয়তা শিল্প ও সেবা খাতে। এই খাতগুলোতে অটোমেশনের পরিমাণ মূল্যায়ন করা দরকার।
ইউএনবি: সম্প্রতি অ্যাক্সেনটেক ও আর-ভেঞ্চারস নামে রবির দুটি সাবসিডিয়ারি ফার্ম প্রতিষ্ঠা কারণ কী?
রাজীব শেঠি: এই সহায়ক সংস্থাগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোতে ইন্টারনেট সেবা সরবরাহ করা। বর্তমানে, এই খাত থেকে আয় ন্যূনতম, তবে ভবিষ্যতে পরিষেবাগুলো প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং একজন নতুন সিইও নিয়োগ করা হয়েছে। এটি লক্ষণীয় যে প্রতিবেশী দেশগুলোতে এরকম ব্যবসায়িক রাজস্ব উল্লেখযোগ্য বেড়েছে।
ইউএনবি: রবি কি পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত শেয়ার ইস্যু করার কথা ভাবছে?
রাজীব শেঠি: এটা পরিচালনা পর্ষদের আওতাভুক্ত। তবে আমার জানামতে আপাতত বিষয়টি বিবেচনায় আনা হচ্ছে না।
ইউএনবি: বাংলাদেশে বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে কোন কোন বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করবেন?
রাজীব শেঠি: বিনিয়োগকারীরা একটি স্থিতিশীল নীতিভিত্তিক পরিবেশ পছন্দ করে কারণ এটি কৌশলগত পরিকল্পনাকে সহজতর করে। বিনিয়োগ সম্পর্কিত সরকারি নীতিতে আকস্মিক পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে। তৃতীয় পক্ষের বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার উপস্থিতি ব্যবসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটি সাধারণত আদালতের মাধ্যমে করা হয়। বিনিয়োগের জন্য মৌলিক প্রয়োজন নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা। টেলিকম খাতে বিনিয়োগের জন্য যদি একটি দেশ নির্বাচন করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ হবে প্রধান পছন্দ। দেশটিতে বিনিয়োগের জন্য অসংখ্য সুবিধা রয়েছে।
ইউএনবি: দীর্ঘ সময় ধরে এখানে কাজ করার পর বাংলাদেশিদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
রাজীব শেঠি: বাংলাদেশের প্রতি আমার গভীর অনুরাগ রয়েছে। এখানকার লোকেরা অবিশ্বাস্যভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং জ্ঞান অর্জন ও শেখার জন্য তাদের গভীর আগ্রহ রয়েছে। ক্রিকেটের প্রতি তাদের আবেগ প্রগাঢ়। দেশটিতে অনেক প্রতিভা রয়েছে, যা বিশ্ব এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। আমরা ডিজিটাল সেক্টরে প্রতিভা অনুসন্ধানে কাজ করেছি এবং আমরা যে ব্যতিক্রমী তরুণ প্রতিভা পেয়েছি তা দেখে অবাক হয়েছি। তারা আমার মতো ৪০ থেকে ৫০ বয়সী নয়, এরা ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণ। তাদের দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য উপযুক্ত একটি প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন।
২০২৩ সালের জন্য রবির আর্থিক তথ্য
রবির রাজস্ব আয় হয়েছে ৯৯.৪২ বিলিয়ন এবং কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৩.২১ বিলিয়ন টাকা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৮০ বিলিয়ন টাকা। কোম্পানিটির গ্রাহক সংখ্যা ৫৫.৭ মিলিয়ন। এটি ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়, যার শেয়ার বাজার মূল্য ৩১.২০ টাকা এবং এর মধ্যে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হয়।
রবির সংক্ষিপ্ত বিবরণ
রবিতে মালয়েশিয়াভিত্তিক আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদের ৬১ দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ভারতের ভারতী এয়ারটেলের হাতে রয়েছে ২৮ দশমিক ১৮ শতাংশ শেয়ার, বাকি ১০ শতাংশ বাংলাদেশের সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। ১৯৯৭ সালে টেলিকম মালয়েশিয়া এবং এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি অব বাংলাদেশ একটেল ব্র্যান্ড নামে যৌথভাবে এই কোম্পানি চালু করে। ২০০৮ সালে এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ২০১০ সালে কোম্পানিটির নাম একটেল থেকে রবিতে পরিবর্তন করে পুনরায় ব্র্যান্ডিং করা হয়।
আরও পড়ুন: চ্যাটজিপিটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম আল্টম্যান বরখাস্ত