বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ এবং পরিচালনার জন্য ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে চুক্তি করে ভারতের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম বড় কোম্পানি রিলায়েন্স। পরে তারা মেঘনাঘাটে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জাপানি কোম্পানি জেরা’কে অংশীদার হিসেবে নেয়ার কথা জানায়।
রিলায়েন্স বাংলাদেশ এলএনজি অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড (আরবিএলপিএল) নামে এ জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানির ২০২২ সালের মধ্যে ৭১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার কথা রয়েছে।
তবে ইউএনবি’র হাতে আসা সরকারি নথিতে দেখা যায়, চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও প্রকল্প কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ।
প্রকল্পের ধীর অগ্রগতির জন্য কোভিড মহামারি এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা লকডাউনকে দায়ী করেছেন রিলায়েন্স গ্রুপের কর্মকর্তারা। তবে প্রকল্পের বাকি ৯১ শতাংশ কাজ দুই বছরেরও কম সময়ে সম্পন্ন করা নিয়ে আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করেছেন তারা।
আরবিএলপিএল’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রঞ্জন লোহার বলেন, ‘কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী গত মার্চ মাসে আমাদের কাজ স্থগিত রাখতে হয়েছিল।’
প্রকল্পের পাইলিংয়ের কাজ আবারও শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।
লোহার আরও জানান, মেঘনা নদীর তীরে এ প্রকল্পটি তৈরিতে অর্থায়নের জন্য সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার সাথে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে রিলায়েন্স।
চুক্তি অনুসারে, আর্থিক সংস্থাগুলো মোট ৬৪ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলারের ঋণ প্রদান করবে। এর মধ্যে ২০ কোটি ডলার দেবে এডিবি। এছাড়া জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশনসহ আরও চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে রিলায়েন্সের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
এদিকে, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজের জন্য জাপানের জ্বালানি সংস্থা জেরা’র সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে নিজেদের জন্য ৫১ শতাংশ এবং বিদেশি ওই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ৪৯ শতাংশ শেয়ারের অনুপাত স্থির করেছে রিলায়েন্স।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বৃহৎ বেসরকারি বিদ্যুৎ প্রকল্পে এডিবির অর্থায়ন
সংস্থাটি জেনারেল ইলেকট্রিকের (জিই) সাথেও একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যারা এ প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সরবরাহ করবে। এছাড়া গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য স্যামসাং সিএন্ডটিকে ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট এবং কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
চুক্তি অনুসারে, মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দুটি জিই ৯এফ গ্যাস টারবাইন, একটি জিই ডি১১ স্টিম টারবাইন এবং তিনটি এইচ৫৩ জেনারেটরচালিত হবে।
এর আগে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সাথে মোট চারটি চুক্তি স্বাক্ষর করে রিলায়েন্স বাংলাদেশ।
কর্মকর্তারা জানান, চারটি চুক্তির মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন চুক্তিতে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিদ্যুৎ ক্রয় ও জমি লিজ চুক্তিতে এবং পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
চুক্তির আওতায়, বাংলাদেশের তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কাছ থেকে গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে রিলায়েন্স বাংলাদেশ এলএনজি অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড। এ কেন্দ্র থেকে ২২ বছর পিডিবিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮০ টাকা ধরে তিতাস গ্যাস প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) গ্যাস বা এলএনজি সরবরাহ করবে ৭ দশমিক ২৬২৫ ডলার দরে। আর রিলায়েন্স এ কেন্দ্রে তাদের উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ পিডিবির কাছে বিক্রি করবে ৭ দশমিক ৩১২৩ সেন্ট বা ৫ টাকা ৮৪ পয়সা দরে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী তিন বছরের মধ্যে এ কেন্দ্র উৎপাদনে যাবে এবং উৎপাদিত ৪০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ পিজিসিবির মেঘনাঘাট সাব স্টেশন হয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ কেনার জন্য ২২ বছরের মেয়াদে সরকারকে মোট ৮০ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা (প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার) ব্যয় করতে হবে।
আরও পড়ুন: ভারতের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়েছে রূপপুরের বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্প
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় রিলায়েন্স গ্রুপ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য একটি সমঝোতা স্বাক্ষর করে। যার মধ্যে ৫০০ এমএমসিএফডি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনও অন্তর্ভুক্ত।
তবে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সাথে নানা ইস্যুতে বিরোধের কারণে সরকারের সাথে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করতে না পারায় ভারতীয় এ সংস্থা পুরো বিনিয়োগ শুরু করতে পারেনি।
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি, বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় গ্যাসের ব্যবহার এবং আমদানি করা গ্যাসের অবশিষ্ট অংশ বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিক্রি করাই রিলায়েন্সের প্রাথমিক পরিকল্পনার অংশ ছিল।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘন ঘন প্রস্তাব পরিবর্তন এবং সরকারের শর্তাবলীর সাথে তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশে প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে রিলায়েন্স।’